মিছিল শুরুর আগেই গ্রেফতার হয়ে যান শুভেন্দু।
হাওড়ায় দু’টি এবং কলকাতায় একটি। তিন মিছিলের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল বিজেপির তিন নেতা সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী এবং দিলীপ ঘোষের। বিজেপির ঘোষণা মতো তিনটি মিছিলই শুরু হওয়ার কথা ছিল দুপুর ১টায়। কিন্তু ১টা বাজার বেশ কিছু ক্ষণ আগেই দেখা গেল কলকাতা থেকে সাঁতরাগাছি যাওয়ার পথে দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে ওঠার আগে পুলিশ আটকে দিয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে। সঙ্গে বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। মিনিট দশেক পুলিশের সঙ্গে বচসার পরেই আটক হয়ে লালবাজার চলে যান শুভেন্দুরা।
এর পরে পরেই সাঁতরাগাছিতে শুরু হয় মিছিল। নেতৃত্বে বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। অতঃপর তুমুল গোলমাল। বিজেপি কর্মীদের ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, আগুন। সাঁতরাগাছির পরিস্থিতি কিছুটা স্তিমিত হতে হতেই শুরু সুকান্তের মিছিল। শুভেন্দু যেমন আগে থেকেই কলকাতায় ছিলেন, তেমনই সুকান্তও সোমবারের রাত কাটিয়েছিলেন হাওড়া স্টেশনের লাউঞ্জে। তাঁর নেতৃত্বে মিছিল আটকাতেও পুলিশের জলকামান, কাঁদানে গ্যাস। তখনও দিলীপ রাজ্য দফতরে বসে। হাওড়া ময়দানে সুকান্তের মিছিল ঘিরে উত্তেজনা স্তিমিত হওয়ার পরে দিলীপ মিছিল নিয়ে রওনা দেন হাওড়া ব্রিজের দিকে। কিন্তু ব্রিজে ওঠার আগেই আটকে যায় মিছিল। চলে জলকামান। সে দিকে যখন সবার নজর, তখন আবার রাজ্য বিজেপি দফতর থেকে আচমকা একটি ছোট মিছিল রওনা দেয় লালবাজারের দিকে। ঠিক তখনই দাউ দাউ করে মহাত্মা গাঁধী রোডে জ্বলতে থাকে পুলিশের গাড়ি।
এত উত্তেজনার মধ্যে সে অর্থে ছিলেনই না শুভেন্দু। যে মিছিলের সামনে তাঁর থাকার কথা, সেটি ঘিরেই মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। আহত হন বেশ কয়েক জন বিজেপি কর্মী। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজে অসুস্থ হয়ে পড়া বিজেপি কর্মীকে। কিন্তু শুভেন্দু তখন লালবাজারে। লকেটকে পাশে নিয়ে ফেসবুক লাইভ করছেন। শুভেন্দু কি গোলমালের পরিস্থিতি এড়াতেই আগেভাগে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে দিলেন? যে প্রশ্ন আরও বেশি করে উস্কে দিয়ে শাসক তৃণমূলের নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘অভিযানের শুরুতেই গাড়িতে উঠে গেলেন? যাঁর এত এত কথা, বিরোধী দলনেতা নাকি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন! পুলিশ ঘিরেছে, বাধা দেবেন না?’’ কুণালের আরও সংযোজন, ‘‘শুভেন্দু তো নিজেই গিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলেন। একটা আস্ত আলুভাতে।’’ তবে গেরুয়া শিবিরের দাবি, সবই পরিকল্পনামাফিক। দলীয় দফতরে তৈরি চিত্রনাট্য মেনেই পদক্ষেপ করেছেন নেতারা। বিজেপির এক নেতা জানিয়েছেন, দলের লক্ষ্য ছিল মঙ্গলবার গোটা দিন ‘খবরে’ থাকা। তিন মিছিলের তিন মুখের মধ্যে শুভেন্দুকে নিয়েই সংবাদমাধ্যম থেকে সাধারণের আগ্রহ বেশি। তিনি যেখানে থাকবেন, স্বভাবতই সেখানকার ছবি ও খবর বেশি সম্প্রচারিত হবে। সেই কারণেই দিনভর শিরোনামে থাকতে গোটা কর্মসূচিকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নিয়েছিল বিজেপি।
প্রথম: কলকাতা থেকে সাঁতরাগাছি যাওয়ার পথে শুভেন্দুর সঙ্গে পুলিশের বচসা। এর পরে আটক হয়ে লালবাজার যাওয়া।
দ্বিতীয়: সাঁতরাগাছিতে গোলমাল। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের মুখোমুখি হওয়া।
তৃতীয়: সুকান্ত ও বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের নেতৃত্বে হাওড়া ময়দান থেকে মিছিল শুরু করে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা। পুলিশি বাধায় সুকান্তদের রাস্তায় বসে পড়া।
চতুর্থ: তৃতীয় মিছিল নিয়ে বিলম্বিত যাত্রা দিলীপের। সেই মিছিল হাওড়া ব্রিজের কাছে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়া। জলকামানের মুখোমুখি হওয়া।
পঞ্চম: আচম্বিতে বিজেপি রাজ্য দফতর থেকে লালবাজারের উদ্দেশে অঘোষিত মিছিল। সেখানে গিয়ে সঙ্ঘাত এবং গ্রেফতার বরণ।
এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত অভিযানগুলির মধ্যে যাতে কোনও সঙ্ঘাত না-হয়, অর্থাৎ একটির সঙ্গে আর একটি যাতে মিশে না যায়, তার জন্য গেরুয়া শিবিরে কন্ট্রোল রুমের কড়া নজরদারি ছিল। একটির সঙ্গে অন্যটির যোগাযোগও রাখা হয়েছিল প্রতি মুহূর্তে। গত কয়েদিন ধরেই বিজেপি নেতারা নবান্ন অভিযানের যে কৌশল ঠিক করেছিলেন, তাতে জোর দেওয়া হয়েছিল সংবাদমাধ্যমকে ‘ব্যবহার’ করার উপর। অর্থাৎ, দিনভর ‘খবরে’ থাকার উপর। তিন মুখই যেন খবরে সমান গুরুত্ব পান, সেটাও পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল। সংবাদমাধ্যমের কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক বিজেপি নেতা মঙ্গলবার দিনের শেষে বলেন, ‘‘আমরা এমন ভাবে কর্মসূচি সাজিয়েছিলাম, যাতে কোনও সময়ই টিভিতে ‘থ্রি উইন্ডো’ করে দেখাতে না হয়। সে ব্যাপারে আমরা সফল। প্রতিটি জায়গার ঘটনা পরম্পরা আলাদা আলাদা করে সম্প্রচারিত হয়েছে।’’
অতীতে এমন ‘কৌশল’ দেখাতে না পারা বিজেপি শিবিরের অন্দরের খবর, এমন পরিকল্পনার পিছনে সদ্য রাজ্য সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনশলের মস্তিষ্ক কাজ করেছে। রাজ্য বিজেপির নেতাদের দাবি, তাঁদের আন্দোলন ‘সফল’। এক দিকে যেমন বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের ‘বাধা’ সত্ত্বেও লোক জোগাড় করা গিয়েছে, তেমনই পুলিশকেও ‘কঠোর পদক্ষেপ’ করতে ‘বাধ্য’ করা গিয়েছে। অভিযানের দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলা সফরে থাকাকেও ‘সাফল্য’ হিসেবেই বর্ণনা করতে চায় বিজেপি। যদিও ওই দাবিকে একেবারেই আমল দিচ্ছে না তৃণমূল। তাদের বক্তব্য, বিজেপি কি ভেবেছিল, নবান্নের ১৪ তলায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে হাজির হবে! ওদের এই অভিযানের ফলে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি হয়েছে, তার ফল ওরা সুদে-আসলে পেয়ে যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy