ইন্দাসের বিধায়ক নির্মল ধাড়া নিজস্ব চিত্র।
পেশা প্রাইভেট টিউশন। সম্পত্তির পরিমাণ সাকুল্যে ১৭০০ টাকা। বিধানসভা ভোটের মনোনয়নে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমনটাই জানিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী নির্মল ধাড়া। হিসেব মতো নির্মলই ছিলেন বিধানসভা ভোটে রাজ্যের সবচেয়ে গরিব প্রার্থী। তিনিই এখন ইন্দাসের বিধায়ক। কিন্তু তার পরেও তাঁকে টিউশন পড়িয়ে যেতে হচ্ছে। পড়ুয়া থেকে অভিভাবক— সকলেরই বক্তব্য, কোনও ভাল শিক্ষক ঠিক না হওয়া পর্যন্ত নির্মলকে তাঁরা ছাড়বেন না। আর বাঁকুড়ার অখ্যাত কুশমুড়ি গ্রামে প্রাইভেট শিক্ষক পাওয়াটা সোজা কথা নয়। বিধায়ক নির্মল তাই ঠিক করেছেন, বিধানসভার বেতন শুরু হয়ে গেলে নিজের গ্রামে একটা অবৈতনিক টিউটোরিয়াল সেন্টার খুলবেন। তিনি বলেন, ‘‘ভেবেছি, ওই টিউটোরিয়াল সেন্টারে বেতন দিয়ে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেদেরই শিক্ষক হিসেবে রাখব। কিন্তু যাঁরা পড়বে তাঁদের কোনও বেতন দিতে হবে না। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। অনেকের রোজগার হবে। বাকিদের লেখাপড়া।’’
টিউশন পড়াতে পড়াতে বিধায়ক হওয়া নির্মলের শোনালেন তাঁর বড় হওয়ার গল্প। বরাবরই ভাগচাষি বাবা নয়ন ধাড়ার নয়নের মণি ছিলেন নির্মল। কিন্তু তিনি যে একদিন বিধায়ক হয়ে উঠবেন, অপরের জমিতে চাষ করতে করতে সে স্বপ্ন কখনওই দেখেননি নয়ন। তবে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলেটা লেখাপড়া করুক। অনেকটা লেখাপড়া। যে সুযোগ তিনি নিজে পাননি। আর এখন শুধু নয়ন কেন, বাঁকুড়া জেলার কুশমুড়ি গ্রামের কেউই ভাবতে পারেনি ‘এমএ পাশ নির্মল’ এক দিন ‘এমএলএ নির্মল’ হয়ে উঠবেন।
বাঁকুড়া শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে কুশমুড়ি গ্রাম। খাল, বিল, পুকুরের সম্পদ বাদ দিলে কুশমুড়ি এক অভাবি গ্রাম। আটপৌরে চেহারার কুশমুড়ির বাসিন্দাদের অনেকের কাছেই উচ্চশিক্ষা বড় বিলাসিতা। সেখানকার নির্মল যখন সোনামুখী কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই কুশমুড়ির গর্ব আর ধরে না। তার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজিতে ‘মাস্টার্স’ ডিগ্রি নিয়ে গ্রামে ফিরে নির্মল টিউশন পড়ানো শুরু করেন। উপার্জনের টান যেমন ছিল, তেমনই কুশমুড়িতে আরও অনেক ‘এমএ’ তৈরি করার মনও ছিল। নির্মল বলেন, ‘‘আমায় অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছেন বাবা। আমাকেও কষ্ট করতে হয়েছে। দরকার থাকলেও প্রাইভেট টিউশন নিতে পারিনি। সেই রকম কষ্ট যাতে কুশমুড়ির পড়ুয়াদের না হয় তাই খুবই কম টিউশন ফি নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করি।’’ একটা সময় ওটাই পেশা হয়ে যায় নির্মলের। এর মধ্যেই নরেন্দ্র মোদীর প্রতি একটা টান তৈরি হয়। নির্মলের কথায়, ‘‘মোদীজিকে আমার আগে থাকতেই খুব ভাল লাগত। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মোদীজিকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে বলেই বিজেপি করতে শুরু করি। তার পরে এখন বিধায়ক হয়ে গেলাম।’’
ইংরেজির ছাত্র হলেও নির্মল বাংলা, ইতিহাস, ভূগোলও দেখিয়ে দেন ছাত্রছাত্রীদের। তাঁরা এমন শিক্ষককে ছাড়তে রাজি নন। দশম শ্রেণির ছাত্রী সুলেখা বড়া বলেন, ‘‘সেই ক্লাস ফাইভ থেকে স্যারের কাছে পড়ছি। খুব ভালবেসে পড়ান। স্যার এমএলএ হয়ে গেছেন বলে ভাল লাগছে কিন্তু ওঁর কাছে আর পড়ার সুযোগ পাব না ভাবলেই মন খারাপ লাগছে।’’ প্রায় একই বক্তব্য নির্মলের ছাত্রী পারমিতার বাবা অসিত মাঝির। তিনি বলেন, ‘‘নির্মল আমাদের গর্ব। আমার মেয়েকে ওঁর হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এখন উনি যদি টিউটোরিয়াল সেন্টার তৈরি করেন, ওঁর পাশে থাকব। এতে তো আমাদের ছেলেমেয়েদেরই মঙ্গল হবে।’’
ভাগচাষির ছেলে নির্মলের আরও গুণ আছে। ফুটবল থেকে ক্রিকেট, গ্রামের সব টিমেই ভরসার খেলোয়াড় এখন আরও বড় ময়দানে। ভাল বক্তা হিসেবেও খ্যাতি তৈরি হয় বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পরে। কুশমুড়ি জানে, এ বার বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়তে চান না নির্মল। তিনি বলেন, ‘‘দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। কিন্তু এখন বিধায়ক হয়েছি বলে অতীত ভুলে যেতে চাই না। গোটা বিধানসভা এলাকার দায়িত্ব সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের গ্রামের মানুষের সঙ্গেও থাকব। মাঠে নেমে খেলতে না পারলেও মাঠের পাশেই থাকব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy