তিন রাজ্যে জয়ের পরেও ভয় রয়েছে বাংলায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিন রাজ্যে বিপুল জয়ের পরে উল্লসিত পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি শিবিরও। নেতারা বলছেন, তিন রাজ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘মুখ’ করে লড়ে সাফল্য এসেছে। আর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তো মোদীই প্রধান মুখ। ফলে ‘মোদীমন্ত্র’ আরও ভাল কাজে দেবে। কিন্তু এ সবের ভিতরেও পাঁচটি বিষয়ে খানিক উদ্বিগ্ন গেরুয়া শিবির। যে বিষয়গুলি লোকসভা নির্বাচনের ময়দানে বিজেপিকে ‘চাপে’ ফেলতে পারে। প্রত্যাশিত ভাবেই প্রকাশ্যে এ সব নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না। তবে দলের অন্দরে লোকসভার প্রস্তুতিপর্বে এমন আলোচনা শুরু হয়েছে।
রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে প্রচলিত ধারনা হল— দিল্লির বিজেপি এবং বাংলার বিজেপি সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি দল। রাজ্যে দলের ‘রাশ’ যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতেই রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারা এসে মাঝেমধ্যেই রাজ্যের সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকও করেন। বিএল সন্তোষ, সুনীল বনশলের মতো কেন্দ্রীয় স্তরের সংগঠক থেকে শুরু করে আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতও নাকি নানা টোটকা দিয়ে যান রাজ্যের নেতাদের। কিন্তু অনেকেই বলেন, সর্বভারতীয় স্তরের সে সব টোটকা বাংলার ক্ষেত্রে সেই কাজে দেয় না। কিছু উদ্বেগ থেকেই যায়। যেমন রয়েছে আগামী লোকসভা ভোটের আগেও। তিন রাজ্য জয়েও যে উদ্বেগ কাটছে না।
উদ্বেগ ১: বিজেপি এবং তৃণমূলের সংগঠনের তুল্যমূল্য বিচার। ২০১৪ সালে যখন গোটা দেশে মোদী জয় পেয়েছিলেন, তখন বিজেপি সব চেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছিল বাংলাতেই। বাংলায় মাত্র দু’টি আসন মিলেছিল। তবে ২০১৯ সালে বিজেপি এক লাফে ১৮টি আসন জেতে বাংলায়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ফল অনুযায়ী ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্য পায়নি বিজেপি। অনেকে অবশ্য বলেন, লোকসভার সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনেরই তুলনা হওয়া উচিত। বিধানসভা ভোটের নয়। কারণ, দু’টি ভোট প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা। আবার অনেকের মতে, ২০১৯ সালে বিজেপির ভাল ফলের পিছনে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের ‘গা-জোয়ারি এবং সন্ত্রাস’-এর ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তৃণমূল ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে পাঁচবছর আগের পুনরাবৃত্তি হতে দেয়নি। পাশাপাশি, তারা সংগঠনও গুছিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সংগঠন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বুথ স্তরে সংগঠন মজবুত না করতে পারলে শুধু মাত্র মোদী-মাহাত্ম্যে ভর করে গত বারের চেয়ে ভাল ফল করা কঠিন।
উদ্বেগ ২: প্রচার। নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের দ্বিতীয় মুখ ঠিকই। কিন্তু রাজ্যের প্রথম সারির মন্ত্রীদেরও তৃণমূল প্রচারের মুখ হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিজেপিতে ভরসা সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী। এখনও পর্যন্ত বিজেপির যা পরিকল্পনা, তাতে দিলীপ ঘোষের জনপ্রিয়তা থাকলেও রাজ্যে তাঁর কোনও সাংগঠনিক দায়িত্ব না থাকায় প্রচারে তাঁকে ‘বিশেষ’ ভাবে ব্যবহার করতে চাইছে না দল। দিলীপও নিজের আসন মেদিনীপুরের দিকেই বেশি করে নজর দিতে চান। সেই ‘খামতি’ মেটাতে বিজেপি অন্য রাজ্যের নেতাদের নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু দেশ জুড়ে লোকসভা ভোটে সকলেই নিজস্ব এলাকায় ব্যস্ত থাকবেন। তবে লোকসভা ভোটে বাংলাতেও গতবারের মতো মোদীর উপর নির্ভরশীল থাকবে রাজ্য বিজেপি। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘তিন রাজ্যে জয়ের পর নরেন্দ্র মোদী যে আরও অনেক শক্তিশালী হয়েছেন, সেটা বলা বাহুল্য। আর মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু মোদীর ভোট। অর্থাৎ, মোদীকে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করার ভোট। সেখানে বাকিদের দাঁড়ানো মুশকিল।’’
উদ্বেগ ৩: প্রার্থী বাছাই। বিধানসভা ভোটে যাঁদের বিভিন্ন কেন্দ্রে দাঁড় করানো হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে থেকে হেরে গিয়েছিলেন তেমন কয়েকজনকে লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহার করতে চায় বিজেপি। বরাবরই নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত কিছু ‘চমক’ দেন মমতা। এ বার তৃণমূলের প্রার্থীদের তালিকা শেষপর্যন্ত কী হয়, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। তৃণমূলের অন্দরে নবীন-প্রবীণের ‘বিতর্ক’ সামলে কাকে কাকে টিকিট দেওয়া হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মমতা যে বিজেপিকে দশের নীচে নামিয়ে আনতে চান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ময়দানে কাদের নামিয়ে তৃণমূলের মোকাবিলা করা হবে, বিজেপিকে এখন থেকেই সেই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে।
উদ্বেগ ৪: বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ বাংলায় কতটা কার্যকর হবে। মমতার সঙ্গে সিপিএমের যে আসন সমঝোতা হবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। রাজ্যে তুলনায় অনেক বেশি ‘শক্তিশালী’ হওয়ায় কংগ্রেসকে মমতা ক’টি আসন ছাড়বেন, তা নিয়েও সংশয় ছিল। কিন্তু তিন রাজ্যে পরাজয়ের পরে কংগ্রেসের ‘দর কষাকষি’র ক্ষমতা খানিকটা কমবে। সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস-তৃণমূলের সফল জোট হলে তা বিজেপির পক্ষে চিন্তার। বিশেষত, উত্তরবঙ্গে। যেখানে বিজেপি গত লোকসভা ভোটে চূড়ান্ত সফল হয়েছিল। এবং যেখানে কংগ্রেসের ভোট দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় বেশি।
উদ্বেগ ৫: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও তিনিই হবেন ‘মুখ’। তাঁকে দেখেই ভোট দেবে মানুষ। অনেকেই বলেন, দেশের তাবড় রাজনীতিকদের মধ্যে ভোটারদের নাড়ি সবচেয়ে ভাল বোঝেন মমতা। তিনি বোঝেন, প্রচারে কখন কোন কথাটা বলতে হবে। কিসের উপর জোর দিতে হবে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে নন্দীগ্রামে দুর্ঘটনা এবং পায়ের চোটকে তিনি নির্বাচনী প্রচারে সফল ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। হুইলচেয়ারে তাঁর প্রচার দেখে মহিলা ভোটারেরা বিপুল ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। নন্দীগ্রামে মমতা নিজে হেরে গেলেও বাকি রাজ্যে যে তাঁর ওই হুইলচেয়ার-প্রচার ছাপ ফেলেছিল, তা পরে বিজেপির নেতারাও স্বীকার করেছিলেন।
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘২০২৪ সালে মানুষ ভোট দেবেন স্থায়িত্বের লক্ষ্য, নির্ণায়ক সরকারের পক্ষে। ভোট দেবেন দেশের বর্ধিত অর্থব্যবস্থা, বিদেশনীতির পক্ষে এবং সর্বোপরি দেশের জনপ্রিয়তম রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে। যাঁর কোনও বিকল্প নেই।’’ শমীকের কথায়, ‘‘আমাদের যুদ্ধ কোনও ছায়ার সঙ্গে নয়। আমাদের যুদ্ধ অমিত শাহের দেওয়া আসনের লক্ষ্য (৩৫টি) ধরে রাখা আর জয়ের মার্জিন বাড়ানো।’’
পক্ষান্তরে, তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘তিন রাজ্যে হিসাব করলে দেখা যাবে বিজেপির থেকে কংগ্রেস এবং অন্য বিজেপি বিরোধী দলগুলি বেশি ভোট পেয়েছে। কংগ্রেসের ভুল নীতির জন্য ভোট কাটাকাটির জেরে বেরিয়ে গিয়েছে। বাংলায় তৃণমূল যে জায়গায় রয়েছে, সেখানে ওদের লোকসভা নিয়ে কিছু ভাবাই উচিত নয়!’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বিজেপির তো কোনও সংগঠনই নেই! ওদের তো নিজেদের বিরুদ্ধেই লড়াই! মোদীর মুখ কার্যকর হলে তো ২০২১ সালেই হত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy