শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দেশ শাসনের স্লোগান ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ বন্ধ করে দেওয়ার ডাক দিলেন বাংলার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী! সেই সঙ্গে বিজেপির সংগঠনে বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাবও দিলেন। বুধবার ছিল রাজ্য বিজেপির বর্ধিত কর্মসমিতির বৈঠক। লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে প্রথম বড় আকারে বৈঠক এটি। সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর। ছিলেন অতীত এবং বর্তমান রাজ্য সভাপতিরা। ছিলেন বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের সামনেই শুভেন্দু ওই বক্তব্য পেশ করেন।
তবে অনেকে বলছেন, শুভেন্দু ‘দলের নেতা’ হিসেবে এমন কথা বলতেই পারেন। কারণ, তিনি সরকারের অঙ্গ নন। কিন্তু মোদী তা বলতে পারেন না। কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রী। এটি তাঁরই সরকারের স্লোগান। এই ধরনের ঘরানার রাজনীতি করতেন বামপন্থীরা। তাঁরা দল এবং সরকারের মধ্যে পার্থক্য রচনা করতেন। সরকারের প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা বলতেন, দলের নেতা হিসেবে তিনি কখনও-সখনও তার বিপরীত অবস্থানে গিয়েছেন। শুভেন্দুর বক্তব্য শুনে অনেকে এই জল্পনাও শুরু করেছেন যে, বিজেপি কি তা হলে সিপিএমের পথে হাঁটতে শুরু করল? সেই সূত্রেই অনেকের জল্পনা, শুভেন্দু যা বলেছেন, তা দলের অনুমতিক্রমেই। নচেৎ তিনি প্রকাশ্যে ওই কথা বলতেন না।
বুধবার দলীয় বৈঠকে শুভেন্দু তাঁর বক্তৃতার প্রথম থেকেই ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, কোন আসনে সংখ্যালঘু ভোট কী ভাবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তাঁর বক্তৃতার মধ্যেই মঞ্চে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খট্টর (আগে কথা ছিল, বৈঠকে যোগ দেবেন রাজনাথ সিংহ। তিনি অসুস্থ থাকায় খট্টরকে ওই বৈঠকে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব)। তার পরেই শুভেন্দু চিৎকার করে বলেন, ‘‘আমিও বলেছি রাষ্ট্রবাদী মুসলিম। আপনারাও বলেছেন সব কা সাথ, সব কা বিকাশ। আর বলব না।’’ এর পরে দু’হাত জড়ো করে কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকেন বিরোধী দলনেতা। তার পরে আবার আগের মতো চিৎকার করে বলেন, ‘‘বলব, যো হামারি সাথ, হাম উনকা সাথ। সব কা সাথ, সব কা বিকাশ বন্ধ করো।’’ বক্তৃতা শেষ করেন বারংবার ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে। শুভেন্দু তাঁর ভাষণে এ-ও স্পষ্ট করে দেন গত লোকসভা নির্বাচনের মতো আগামী দিনেও সব ভোটে বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণের পক্ষে হাঁটতে চান তিনি।
মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠেছিল, হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শাসনে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিণতি কী হবে? সেই উত্তর দিতে গিয়ে ২০১৪ সালেই মোদী ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সব শ্রেণি, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষের বিকাশ বা উন্নতিই হবে তাঁর শাসনের মন্ত্র। পাঁচ বছর পরে ২০১৯ সালে মোদী এই স্লোগান নিয়ে ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন যে, তিনি সকলের বিকাশ বা উন্নতি করতে পেরেছেন। সেই সময়ে সামগ্রিক ভাবেই বিজেপির স্লোগান হয়ে ওঠে ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’। অর্থাৎ, সকলকে সঙ্গে নিয়েই সকলের উন্নতি সাধন। কোনও দিন সংগঠনের কোনও স্তর থেকেই ওই স্লোগানের সমালোচনা হয়নি। দল আর সরকার যে আলাদা, মূলত সেটি প্রমাণের জন্যই যে এই স্লোগান তিনি দিয়েছিলেন, তা বোঝাতে চেয়েছিলেন মোদী। পরে বিজেপিও তা গ্রহণ করে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে মোদী স্লোগানটি আরও বড় করেন। ২০১৪ সালের চেয়েও বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে মোদী স্লোগান তোলেন— ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’। অর্থাৎ, সকলকে সঙ্গে নিয়ে, সকলের আস্থা বা বিশ্বাস অর্জন করে সকলের উন্নতি সাধন। সেই স্লোগানেরও কোনও সমালোচনা হয়নি বিজেপিতে।
এই প্রথম তার ব্যত্যয় হল। তা-ও বাংলার বিরোধী দলনেতার মুখে! তবে মোদীর ‘প্রিয়’ স্লোগান বন্ধ করে দেওয়ার যে ডাক তিনি দিয়েছেন, বৈঠকে উপস্থিতদের সেই ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর বলা স্লোগানে অংশ নিতে বলেছেন শুনে হতবাক রাজ্য বিজেপির নেতারা। মঞ্চে উপস্থিত রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষদের চোখমুখ দেখে খানিকটা ‘অস্বস্তি’ টের পাওয়া যাচ্ছিল। খট্টরের উপস্থিতিতে শুভেন্দুর ওই ঘোষণায় হতচকিত হতে দেখা যায় কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডেদেরও।
তবে মোদী-প্রণীত ওই স্লোগান ‘বন্ধ করো’ বলে আওয়াজ তোলার পরেই শুভেন্দু বিজেপির সাংগঠনিক বদলের প্রস্তাবও দেন। তিনি সরাসরি দাবি করেন, দলের সংখ্যালঘু মোর্চার প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি যে সংগঠনের কেউ নন, সেই দাবি করলেও বক্তৃতার একেবারে শেষে বলেন, ‘‘নো নিড ফর সংখ্যালঘু মোর্চা।’’
প্রসঙ্গত, বিজেপির জন্মের সময় থেকেই দলের সাতটি মোর্চা রয়েছে। মহিলা, যুবর মতোই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসাবে ধরা হয় সংখ্যালঘু মোর্চাকে। যদিও গত কয়েক বছর ধরেই রাজ্য বিজেপি সংখ্যালঘু মোর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখন ওই মোর্চার রাজ্য সভাপতি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চার্লস নন্দী। ২০১৯ সালেও রাজ্য থেকে দু’জন সংখ্যালঘু সাংসদ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এ বার জন বার্লাকে প্রার্থী করা হয়নি। হেরে গিয়েছেন এসএস অহলুওয়ালিয়া। তবে গোটা দেশে দল যে কাঠামো অনুযায়ী চলে, সেটা বন্ধ করার প্রস্তাব এমন খোলাখুলি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য বিজেপিতে। রাজ্যের এক প্রবীণ বিজেপি নেতার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘অতীতে হয়নি এমন অনেক কিছুই তো আজকাল হচ্ছে! জানি না, দলের রীতি এমন ভাবে ভাঙা যায় কি না।’’
শুভেন্দুর ঠিক আগেই সুকান্ত তাঁর বক্তৃতায় মোদীর ‘নীতি ও নেতৃত্ব’ মেনে এগিয়ে চলার বার্তা দেন বাংলার নেতা-কর্মীদের। শুভেন্দুর দুই প্রস্তাব শোনার পরে বক্তৃতা দিতে উঠে মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য খট্টরও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই বিজেপি আগামী দিনে কাজ করবে বলে জানিয়ে দেন। তবে তিনি শুভেন্দুর মন্তব্যের পাল্টা একটি শব্দও খরচ করেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy