(বাঁ দিকে) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনের আগে রেললাইন যেন রাজনীতির পথ হয়ে উঠছে। বাংলায় রেলের প্রকল্প আনায় উঠেপড়ে লেগেছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা। সাংসদ, বিধায়কেরা আলাদা আলাদা করে রেলের কাছে একের পর এক দাবি জানিয়ে চলেছেন। নিজের এলাকায় কেউ পাচ্ছেন রাজধানীর স্টপেজ তো কেউ অমৃত ভারত স্টেশন। যা দেখে তৃণমূল বলতে শুরু করেছে, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নকল করছে বিজেপি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দেশের রেলমন্ত্রী থাকার সময়েই দেখিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের উন্নতির জন্য কী ভাবে কাজ করা যায়। এত দিন পরে সেই কাজটাই করছে বিজেপি। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, মমতার পরিকল্পিত প্রকল্প রূপায়ণের মাধ্যমেও নিজেদের প্রচার চাইছে বিজেপি। পাল্টা যুক্তি রয়েছে গেরুয়া শিবিরেরও। তবে এটা ঠিক যে, মমতার মতোই রেলের ব্রডগেজ লাইনকেই ভোটের লাইন মনে করছে বিজেপি।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে দু’বার রেলমন্ত্রী হয়েছেন মমতা। প্রথম বার ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভা থেকে অবশ্য মেয়াদ শেষের আগেই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। পরে মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভাতেও রেল মন্ত্রক পেয়েছিলেন মমতা। ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দায়িত্ব সামলেছেন। এর পরে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলেও রেল মন্ত্রক তৃণমূলের হাতেই ছিল। পর পর দীনেশ ত্রিবেদী ও মুকুল রায় রেলমন্ত্রী হন। এই দুই পর্বে বাংলার রেলের উন্নতির জন্য মমতা যে অনেক কাজ করেছিলেন তা সকলেরই জানা। মমতার সময়েই বাংলা দু’টি রাজধানী এক্সপ্রেস কিংবা দুরন্ত পেয়েছিল। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই ‘আদর্শ স্টেশন’ হয়েছিল। একটা সময়ে ‘বাংলার রেলমন্ত্রী’ কটাক্ষও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। এর জবাবও পরে দিয়েছেন মমতা। ২০২১ সালে দলীয় মুখপত্রে তিনি লেখেন, “আমার রাজ্য বাংলা। আমি তার জন্য কাজ করতে পেরে গর্বিত। তাতে যদি কারও গায়ে ফোস্কা পড়ে, কিছু বলার নেই। দেশের মানুষ জানে, আমি সব রাজ্যের জন্য কাজ করেছি। জাগরণের পথে এগিয়ে দিয়েছি ভারতীয় রেলকে।”
মমতার আগে বাংলা থেকে রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেসের গনি খান চৌধুরী। স্থানীয় ওই সাংসদের জমানায় রেলের অনেক প্রকল্প মালদহ পেয়েছিল। জেলা থেকে রেলে অনেক কর্মসংস্থানও হয়েছিল। কিন্তু মমতা গোটা বাংলাতেই নজর দেন। সেই সময়ের কথা জানাতে গিয়ে মমতা লেখেন, ‘‘২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর আমি লক্ষ্য করি, ১০ বছর বাংলাকে ভয়ঙ্কর ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। প্রথম বাজেটেই ৫২টি ট্রেন বাংলাকে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে ভারততীর্থ, মাতৃভূমির মতো ট্রেন রয়েছে।’’ বিজেপিকে আক্রমণ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমি যে বলি না, বিজেপি দলটি পুরো বাংলা-বিরোধী, তা স্পষ্ট হয়েছিল ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে। আমার সব রেল বাজেটে ওদের প্রতিক্রিয়া ছিল, বাংলাকে কেন প্রকল্প দিয়েছি? তাই নিয়ে ওদের রাগ। আজ রেল বাজেটটাই এই দলটা তুলে দিয়েছে।’’
মমতা রেলমন্ত্রী থাকার সময় নিয়ে সরব তৃণমূলও। এই প্রসঙ্গে দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে বাংলার জন্য যা যা করেছেন তা দিয়েই একটা গোটা নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। তাতে বিপুল সাফল্য পাবে তৃণমূল।’’ কুণালের বক্তব্য, উত্তরবঙ্গের জন্য সুপার ফাস্ট শতাব্দী এক্সেপ্রেস-সহ একাধিক ট্রেন মমতাই চালু করেছিলেন। দুরন্ত এক্সপ্রেসের মতো অজস্র নতুন ট্রেন তাঁরই পরিকল্পনা ছিল। একাধিক বিশ্বমানের স্টেশন, নতুন লাইন, সাগর-পাহাড়কে রেলপথে জুড়ে দেওয়া— সবই মমতার সাফল্য। আবার মমতার আমলেই কলকাতায় নিউ গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রোপথের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হয়েছিল। বারাসত, দক্ষিণেশ্বর, ব্যারাকপুর, জোকা, হাওড়া, সল্টলেক, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মেট্রো সম্প্রসারণের উদ্যোগ তাঁরই ছিল।
বিজেপি অবশ্য এ সবের জন্য মমতাকে কৃতিত্ব দিতে নারাজ। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘মমতার আমলে ভিত্তিপ্রস্তরই শুধু পোঁতা হয়েছিল। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যা হওয়ার এখন হচ্ছে। এখানেই বিজেপির সঙ্গে ফারাক। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বাংলায় রেলের যে উন্নতি হয়েছে তা অতীতে কখনও হয়নি। এখন রাজ্যে বন্দেভারতের সংখ্যাই পাঁচ।’’ বিজেপি যে রেলের উন্নয়ন দেখিয়ে মানুষের কাছে যেতে চায় তা-ও জানিয়েছেন সুকান্ত। তিনি বলেন, ‘‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সিদ্ধান্তে বাংলায় ট্রেন চালু করেছিলেন। তৃণমূলেরও কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। তিনিই সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা সেটা করিনি। দলের সাংসদ থেকে বিধায়ক— সকলেই নিজেদের এলাকার প্রয়োজনের কথা রেলকে জানিয়েছি। রেল দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’
বিজেপি নেতারা যে রেলের কাছে নিজের এলাকার জন্য একের পর এক দাবি জানিয়েছেন, তার উদাহরণ অনেক। আর সেই দাবির তালিকায় রয়েছে নন্দীগ্রামও। মমতা রেলমন্ত্রী থাকার সময়েই নন্দীগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনের পরিকল্পনা করেছিলেন। সদ্য তা নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে রেল। এটা বিজেপির চাহিদাতেই সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেন দলের নেতারা। গত রেল বাজেটেই বালুরঘাট-হিলি রেল প্রকল্পের জন্য ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। সম্প্রতি আরও ১৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রেল। এই প্রকল্পও মমতাই ঘোষণা করেছিলেন। তবে নির্মলা অর্থ বরাদ্দের পরে বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘অতীতেও কেন্দ্র এই প্রকল্পের জন্য টাকা দিয়েছিল। কিন্তু রাজ্য জমি নিয়ে টালবাহানা করায় ফিরে গিয়েছিল। আমি এবং বালুরঘাটের বিধায়ক অশোক লাহিড়ীর চেষ্টায় তা ফিরে এসেছে।’’ সুকান্ত সম্প্রতি রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের কাছে বালুরঘাটের জন্য নতুন ট্রেন-সহ রেল উন্নয়নের একাধিক দাবি জানিয়েছেন। বুনিয়াদপুর-কালিয়াগঞ্জ রেল প্রকল্প এবং গাজল-গুঞ্জরপুর ভায়া ইটাহারের ঘোষিত রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে দাবি জানিয়েছেন। বালুরঘাট থেকে সরাসরি কাটপাডি (ভেলোর) যাওয়ার ট্রেনও চেয়েছেন রেলমন্ত্রীর কাছে।
একা সুকান্ত নন, দলের অন্য নেতারাও রেলকে ভোটের জন্য ব্যবহার করতে মরিয়া। বেশ এগিয়ে দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তা। নকশালবাড়িতে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের স্টপেজ থেকে মিরিকে টয় ট্রেন নিয়ে আসা অনেক দাবি তাঁর। কিছু কিছু পেয়েছেনও। হাওড়া থেকে বন্দে ভারত চালুর পরে তিনি চেয়েছে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে ট্রেন চালাক রেল। ইতিমধ্যেই সেই আবেদন জমা পড়েছে রেল মন্ত্রকে।
সম্প্রতি রেল এমন সিদ্ধান্তও জানিয়েছে যে, আগরতলা থেকে দিল্লি যাওয়ার রাজধানী এক্সপ্রেস মালদহ স্টেশনেও দাঁড়াবে। যাওয়া এবং আসার পথে ১০ মিনিট করে দাঁড়াবে। মালদহে আগে কোনও রাজধানী এক্সপ্রেস থামত না। অনেক দিন ধরেই তাই যে কোনও একটি রাজধানী এক্সপ্রেসকে মালদহে আনার বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র মজুমদার। সেই দাবি মানতে গিয়ে ট্রেনটির রুটই বদলে দিয়েছে রেল। এত দিন পর্যন্ত আগরতলা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে নিউ জলপাইগুড়ির পরে রাজধানী এক্সপ্রেস সোজা গিয়ে থামত বিহারের কাটিহার জংশনে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে পরিবর্তিত রুট অনুযায়ী, নিউ জলপাইগুড়ির পর মালদহ টাউন হয়ে ট্রেনটি বিহারে ঢুকবে।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে অনেকেই অনেক দাবি জানিয়েছেন। কেউ নতুন ট্রেন চেয়েছেন, কারও আবার দাবি ভাল ট্রেনের স্টপেজ। রেলমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন ঘাটালের বিজেপি বিধায়ক শীতল কপাটও। তাঁর প্রস্তাব, পাঁশকুড়া থেকে ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা পর্যন্ত রেলপথ হোক। রেলমন্ত্রী ভেবে দেখার কথা দিয়েছেন বলেও বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলায় ৩৭টি ‘অমৃত স্টেশন’ গড়ার ঘোষণা করেছে রেল। উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সে দিন তো উৎসবের আবহ ছিল বিজেপি শিবিরে। নিজের নিজের এলাকার প্রস্তাবিত স্টেশনে হাজির ছিলেন দলের সাংসদ, বিধায়কেরা।
শুধু সাংসদ, বিধায়করাই নন, দলের অনেক নেতাও নিজের এলাকায় রেলের উন্নয়ন নিয়ে তৎপর। গত বিধানসভা নির্বাচনে নিজের শহর সিউ়ড়িতে পরাজিত হয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। রেলের প্রকল্প আনায় নাকি তিনি এগিয়ে থাকাদের মধ্যে অন্যতম। সিউড়ি থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত নতুন ট্রেন আনার পিছনে তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর পরে সিউড়ি-হাটজানবাজার রেলওয়ে ওভারব্রিজের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য রেলমন্ত্রীকে অনুরোধ করে তিনি যে সফল হয়েছেন, ফেসবুকে সেই দাবি জানিয়েছেন জগন্নাথ। আবার সোমবারই দাবি করেছেন, তিনি চাওয়ায় বনাঞ্চল এক্সপ্রেস এবং দিঘা-মালদহ এক্সপ্রেস সিউড়িতে দাঁড়াবে বলে আশ্বাস দিয়েছে রেল বোর্ড।
রেল শহর খড়্গপুরের জন্য অতীতে অনেক দাবিদাওয়া আদায় করেছেন বলে দাবি করেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। অতীতে তিনি খড়্গপুর সদরের বিধায়কও ছিলেন। তবে মেদিনীপুরের সাংসদ হিসাবে রবিবার বড় প্রাপ্তি হল তাঁর। হাওড়া-রাঁচী বন্দে ভারত দাঁড়াবে খড়্গপুর স্টেশনে। ট্রেনটি ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়াতেও দাঁড়াবে। এই বন্দে ভারত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির গড় জঙ্গল মহল ধরে রাখতে সাহায্য করবে বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy