মুকুল রায়। ফাইল ছবি।
দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় কী করবেন? বিধানসভা ভোট এবং তৎপরবর্তী দলীয় কোন্দল, দোযারোপ এবং পাল্টা দোযারোপে ধ্বস্ত রাজ্য বিজেপি-তে এই নিয়ে গুঞ্জন এবং জল্পনা চরমে। যে জল্পনাকে বিশ্বাস করতে গেলে বলতে হয়, বিজেপি-তে মুকুলের দিন ফুরনোর পথে। সল্টলেকের বাড়িতে ঘন ঘন অনুগামীদের নিয়ে বৈঠক করছেন তিনি। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় রোজই অনুগামীরা দেখা করতে আসছেন মুকুলের সঙ্গে দেখা করতে। সে সব দেখাশোনা বা বৈঠক সম্পর্কে সকলেরই মুখে কুলুপ। কিন্তু যেটুকু নির্যাস চুঁইয়ে বাইরে আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, মুকুল-বিজেপি দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। যা থেকে প্রশ্ন উঠেছে— তিনি কি পদ্মফুল ছেড়ে আবার জোড়াফুলের পথে? তিনি নিজে যোগ না–দিলেও তাঁর অনুগামীরা কি অদূর ভবিষ্যতে সদলে ফুলবদল করতে চলেছেন?
মুকুল নিজে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠমহল থেকে দলবদলের কথা প্রকাশ্যে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুকুল যে বিজেপি-তে খুব ‘স্বস্তি’-তে নেই, তা স্বীকার করে নিয়েও তাঁর অনুগামীরা বলছেন, ‘‘দাদা বিজেপি-তেই ছিলেন। থাকবেনও। এখন তো উনি বিজেপি-র বিধায়কও। দলবদল করলে তো দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁর বিধায়কপদ চলে যাবে!’’ যা তাঁরা বলছেন না, বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরে গেলে সারদা এবং নারদা মামলায় নিজেকে আরও ‘স্পর্শকাতর’ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেবে মুকুলের রাজনৈতিক জীবনে। সেই ঝুঁকি কি মুকুল নেবেন? দ্বিতীয়ত, মুকুল ইচ্ছা প্রকাশ করলেই কি তৃণমূল তাঁকে ফিরিয়ে নেবে? বিশেষত, যখন দলবদলকারী নেতানেত্রীদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বস্তুত, দলেরই একাংশ থেকে দাবি উঠেছে, অন্তত পুরভোটের আগে যেন কোনও নেতানেত্রীকে যেন ফিরিয়ে না নেওয়া হয়। দলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, ‘‘যাঁরা এখন সরাসরি ফিরে আসার আর্জি জানাচ্ছেন অথবা নেটমাধ্যমে বিভিন্ন বিজেপি-বিরোধী পোস্ট করে পরোক্ষে আমাদের কাছে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, দলে ফিরলেই তাঁদের একটা অংশ অন্তত কাউন্সিলারের টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে দলের মধ্যে ডামাডোল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা।’’ অন্য এক শীর্ষনেতার মতে, ‘‘ধরা যাক, ভোটে পরাজিত কোনও নেতাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হল। আমাদের যে নেতা তাঁকে ভোটে হারিয়েছিলেন, তিনি ওই প্রত্যাবর্তনকে কি ভাল চোখে দেখবেন? যাঁর বিরুদ্ধে কয়েকদিন আগেই ভোটে লড়ে জিতলেন, তাঁর পাশে বসে দলের বৈঠক করবেন? এটা কি সম্ভব বলে মনে হয়?’’
ওই নেতাদের কথা মেনে নিলেও একইসঙ্গে এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, মুকুল ভোটের আগের ‘দলবদলু’-দের মধ্যে পড়েন না। তিনি অনেক আগেই বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন। দলে তিনি জাতীয় স্তরের পদাধিকারীও বটে। কিন্তু প্রথম থেকেই বিজেপি-র ‘সংস্কৃতি’-র সঙ্গে তাঁর সে ভাবে মিলমিশ হয়নি। দলের অন্দরে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তাঁর অবনিবনার কথাও বিজেপি-র অন্দরে কারও অজানা নয়। এতদিন তা চেষ্টাচরিত্র করে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই পারস্পরিক অপছন্দের কথা অন্তত প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু সম্প্রতি মুকুলের স্ত্রী-র অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে তা সকলের সামনে এসে পড়েছে। বিষয়টা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেননি মুকুল নিজেও। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুকুলপুত্র শুভ্রাংশুর ফেসবুক পোস্ট এবং প্রকাশ্যে বিভিন্ন বক্তব্য। যা ভোটে হারের জন্য সরাসরি বিজেপি-কে কাঠগড়ায় তুলেছে। ভোটে মুকুল জিতলেও শুভ্রাংশু হেরে গিয়েছেন। তার পর থেকেই তিনি প্রথমে ঘনিষ্ঠমহলে এবং পরে প্রকাশ্যে নিজের বর্তমান দলের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। সেই সমালোচনায় মুকুলের ‘অনুমোদন’ নেই, এমনটা মনে করার কোনও কারণ দেখছেন না বিজেপি রাজ্যনেতৃত্ব। কারণ, দলত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে মুখ না খুললেও এবং নিজের তাসটি আস্তিনে রেখে দিলেও মুকুল অধুনা প্রকাশ্যেই বিজেপি-র থেকে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছেন। দিলীপের ডাকা দলের বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না। এমনও জানাচ্ছেন যে, তাঁকে কেউ বৈঠক সম্পর্কে জানায়নি। অর্থাৎ, কোনও রাখঢাক অন্তত তাঁর তরফে আর নেই। যা মুকুলের তরফে ‘সঙ্কেত’ বলে মনে করছেন তাঁর অনুগামীরা। মনে করছেন রাজ্য রাজনীতির কারবারিরাও।
অতঃপর প্রশ্ন— যদি সত্যিই মুকুল অনুগামীদের নিয়ে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন, বা তাঁর অনুগামী বলে পরিচিতদের বড় অংশ বিজেপি ছেড়ে ‘ঘরে’ ফেরেন, তা হলে কি তিনি সারদা-নারদা মামলায় নিজেকে বিপন্ন করে ফেলবেন? দল বদল করার পর বিধায়কপদ চলে গেলেই বা কী হবে?
মুকুল-অনুগামীদের কাছে দু’টি প্রশ্নেরই জবাব আছে। সে জবাব তর্কসাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে তাঁরা ওই যুক্তিই দিচ্ছেন। প্রথমত, তাঁরা মনে করছেন, নারদা মামলায় মুকুলের চেয়েও বেশি ‘স্পর্শকাতর’ অবস্থানে রয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মুকুলের গায়ে হাত পড়লে তাঁকেও ছুঁতে হবে বিজেপি-কে। আর দল বদলে বিধায়কপদ খোয়ালে তা মুকুলকে সে ভাবে স্পর্শ করবে না বলেই তাঁর অনুগামীদের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, মুকুল কখনও সে ভাবে পরিষদীয় বা সংসদীয় রাজনীতিতে উৎসাহী ছিলেন না। রাজ্যসভার সাংসদ থেকেছেন বটে। কিন্তু সেটাও নামেই। তাঁর অনেক বেশি উৎসাহ এবং স্বাচ্ছন্দ্য পিছন থেকে কৌশলী ভূমিকায়। তৃণমূলেও তিনি বরাবর সেটাই করে এসেছেন। এক অনুগামীর কথায়, ‘‘উনি সে অর্থে জননেতা নন। হতেও চাননি। এ বার বিজেপি ওঁকে ভোটে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিল বলে উনি দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু উনি যে ভোটে লড়তে চান না, সেটা দলের শীর্ষনেতৃত্বকে স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন। ভোটে উনি জিতেছেন ঠিকই। কিন্তু পরিষদীয় ভূমিকায় উনি খুব স্বচ্ছন্দ যে বোধ করেন না, সেটা উনিও জানেন। ফলে উনি যদি বিধায়ক না-ও থাকেন, তা হলেও রাজনীতিক হিসেবে খুব একটা কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে তাঁকে জলে মাছের মতো স্বচ্ছন্দ থাকতে হবে। যেটা তিনি বিজেপি-তে পাচ্ছেন না।’’
মুকুল-অনুগামীরা এমনও মনে করেন যে, লোকসভা ভোটে তাঁর ‘সাফল্য’-এর পরেও তাঁকে ‘যোগ্য সম্মান’ দেয়নি বিজেপি। অনেক পরে তাঁকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিধানসভা ভোটেও তাঁকে ‘সংগঠক’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বরং একটি আসনে প্রার্থী করে ভোট সংগঠনের যাবতীয় প্রক্রিয়া থেকে দূরেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই আবহে ভোট-পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের তরফে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের প্রতি যে মনোযোগ দেখা গিয়েছে, তাতে অভিভূত ‘রায়সাহেব’। এখন দেখার, সেই অভিভূতি পদ্মপত্র থেকে জলবিন্দুকে গড়িয়ে ঘাসফুলের উপর ফেলে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy