বুধবার তৃণমূল যুব সংগঠনের নতুন রাজ্য কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তৃণমূলের রাজ্য যুব সংগঠনের কমিটিতে নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানসন্ততিদের ঠাঁই পাওয়া নিয়ে নতুন করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্যে ‘পরিবারতন্ত্র’ চালানোর অভিযোগ তুলল বিরোধী বিজেপি। বস্তুত, ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে বিজেপি বরাবরই সরব। সে জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধী পরিবার নিয়েই হোক আর রাজ্যে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার।
তবে শাসক তৃণমূলের পাল্টা যুক্তি—রাজনৈতিক পরিবারের নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে এগিয়ে নিয়ে আসাই দলের লক্ষ্য। তারা বরং বিজেপিতেও ‘পরিবারতন্ত্র’ চলার উদাহরণ দিয়েছে।
দেশ থেকে ‘পরিবারতন্ত্র’ হটানোর ডাক দিয়েছে বিজেপি। সরব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বারবার বিভিন্ন রাজ্যে ‘পরিবার রাজনীতি’ নিয়ে প্রশ্নে তুলেছেন তিনি। তা বন্ধ করার শপথও শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। মোদী তথা বিজেপি সরব পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্য হিসাবে বারবার আক্রমণের মুখে পড়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই আক্রমণই নতুন মাত্রা পেয়েছে বুধবারের কমিটি ঘোষণায়।
বুধবার যুব তৃণমূলের পূর্ণাঙ্গ রাজ্য কমিটির তালিকা (মমতার অনুমোদিত) প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায়, সেই কমিটিতে তৃণমূল নেতাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই রয়েছেন। কেউ কেউ আগে থেকেই ছিলেন। তাঁদের যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই কেউ কেউ নতুন এসেছেন।
রাজ্য সভানেত্রী সায়নী ঘোষের নেতৃত্বে ৪৭ জনের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ১৭ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর পুত্র সৌরভ বসু, মন্ত্রী শশী পাঁজার মেয়ে পূজা পাঁজা এবং উত্তর কলকাতার নেতা সঞ্জয় বক্সীর পুত্র সৌম্য বক্সী। মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র সায়নদেব চট্টোপাধ্যায়ও সাধারণ সম্পাদক। পদ পেয়েছেন বাম জমানার প্রয়াত মন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর কন্যা তথা কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর বসুন্ধরা গোস্বামী। তৃণমূল রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর পুত্র সপ্তর্ষি বক্সীকে সম্পাদক করা হয়েছে। এই প্রথম তৃণমূলের কোনও সাংগঠনিক পদে এলেন সপ্তর্ষি। একই পদ দেওয়া হয়েছে প্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের কন্যা শ্রেয়া পাণ্ডেকে। কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র তথা কাশীপুর বেলগাছিয়ার বিধায়ক অতীন ঘোষের মেয়ে প্রিয়দর্শনী ঘোষকেও সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে চার জন সহ-সভাপতি রাখা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন বিধায়ক— অভিনেতা তথা চণ্ডীপুরের বিধায়ক সোহম চক্রবর্তী এবং বাঘমুণ্ডির বিধায়ক সুশান্ত মাহাত। তাঁদের সঙ্গেই সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহার পুত্র অর্পণ সাহা। একই ভাবে সহ-সভাপতি করা হয়েছে নদিয়া জেলা তৃণমূলের ‘দাপুটে’ নেতা শঙ্কর সিংহের পুত্র শুভঙ্কর সিংহকে।
এই কমিটি নিয়েই ‘পরিবারতন্ত্র’-এর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে বিজেপির। দলের রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘অন্য রাজনৈতিক দলের পরিবারের কথা বলা ঠিক নয়। তবে তৃণমূল মানেই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি। ওপরের দিকে পরিবারতন্ত্র থাকলে তা নীচের দিকেও যায়। দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন উত্তরাধিকারী রয়েছেন, তেমনই নীচুতলাতেও উত্তরাধিকারী তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশেই পরিবারতন্ত্রের যে পরিকাঠামো, তারই অঙ্গ তৃণমূল। বিচ্ছিন্ন কিছু তো নয়!’’
যার জবাবে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা (তাঁর পুত্র রয়েছেন কমিটিতে) আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, ‘‘আমার ছেলে বা অন্যরা অনেকে আগে থেকেই কমিটিতে ছিল। আর এটা একেবারেই পরিবারতন্ত্র নয়! পরিবারে একটা পরিবেশ তৈরি করা, যাতে বাবা-মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে মানুষের জন্য কাজ করার প্রবণতা তৈরি করা। বাবা-মা কী করছেন দেখেই তো সন্তানেরা শিখবেন। আমার মধ্যে মানুষের জন্য কাজ করার যে ইচ্ছে, সেটা যদি সন্তানের মধ্যে যায়, তাতে ক্ষতি কী?’’ একই সঙ্গে চন্দ্রিমা বলেন, ‘‘অন্যরাও আসবে। দেখা যায় অনেকে নিজেরা রাজনীতি করলেও বাড়ির লোককে পাঠান না। আমরা সেই কাজের দৃষ্টান্ত তৈরি করছি।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়েও প্রশ্ন তৃণমূলের। চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘অধিকারী বাড়ির সকলেই তো রাজনীতিতে! তবে কি সেটাও পরিবারতন্ত্র?’’ কিন্তু শিশির অধিকারী এবং দিব্যেন্দু অধিকারী তো তৃণমূলেই ছিলেন। এখনও রয়েছেন। চন্দ্রিমার জবাব, ‘‘আমি তৃণমূল করার কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি রাজনীতি করার কথা।’’
‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে শুভেন্দুর পাশাপাশি আর এক বিজেপি নেতা সজল ঘোষকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল। সজলের বাবা প্রদীপ ঘোষ দীর্ঘদিনের রাজনীতিক। সজল তাঁর উত্তরসূরি। তবে সজলের বক্তব্য, ‘‘বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম। কিন্তু প্যারাশুটে করে নামিনি বা লিফটে করে উঠিনি। জীবন শুরু করেছিলাম ছাত্র রাজনীতি দিয়ে। সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। মামলা, জেল, আদালত সামলাতে হয়েছে। প্রথম দিন কাউন্সিলর হয়ে রাজনীতি শুরু করিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমায় একবার উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছিলেন।’’
শুভেন্দুকে নিয়ে তৃণমূলের আক্রমণেরও জবাব দিয়েছেন সজল। তিনি বলেন, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু করেছেন। লক্ষ্মণ শেঠকে হারিয়েছেন। একেবারে প্রথম দিনই বিরোধী দলনেতা হয়ে যাননি!।’’
রাজনীতিতে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র বিসিসিআই সচিব জয় শাহের প্রসঙ্গও টেনেছেন চন্দ্রিমা। বলেছেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিবার খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে। সেটাও তো পরিবারতন্ত্র।’’ যা নিয়ে শমীকের পাল্টা, ‘‘জয় শাহ দলের কেউ নন। দেশে বিজেপির কয়েকজন বিধায়কের পুত্ররা বিধায়কও রয়েছেন। কিন্তু ফারাকটা হল, তাঁদের কাছে দলের মালিকানা নেই।’’
বস্তুত, রাজনীতিকের সন্তানদের রাজনীতিতে আসা নিয়ে প্রশ্ন তোলাতেই আপত্তি তৃণমূলের। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘চিকিৎসকের ছেলে চিকিৎসক হতে পারলে, ইঞ্জিনিয়রের ছেলে ইঞ্জিনিয়র হতে পারলে রাজনীতিতে হবে না কেন! রাজনীতিকে খারাপ কেন মনে করা হবে? রাজনৈতিক বাড়ি থেকে রাজনীতিক উঠে আসা তো খারাপ নয়। অথচ যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাই রাজনীতির গায়ে কালো ছোপ ফেলছেন। রাজনীতি মানে রাজার নীতি। আমার সন্তানকে তাতে যুক্ত করতে পারলে অসুবিধা কোথায়?’’
একই সুর তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের সদস্য মন্ত্রী শোভনদেবের পুত্র সায়নদেবের। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো ২০১৪ সাল থেকে রাজ্য সম্পাদক। আর ২০০৩ থেকে যোগেশচন্দ্র আইন কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। বিবেচনা করেই নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাঁরা কমিটিতে রয়েছেন, তাঁরা সকলেই রাজনীতিতে যুক্ত। তাঁদের পরিবারও রাজনীতিতে আছে বলে কি তাঁরা রাজনীতি করতে পারবেন না? চিকিৎসকের ছেলে চিকিৎসক হলে, অভিনেতার ছেলে অভিনেতা হলে তো কারও আপত্তি থাকে না! কেউ নীচু স্তর থেকে উঠে এলে পদ পেতেই পারেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy