মূর্তির দেবতায় রূপান্তর। ছবি: সংগৃহীত।
গবেষণার জন্য যে মূর্তি সংগ্রহশালায় থাকা দরকার, তার স্থান হয়েছে মন্দিরে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের পরিবর্তে মূর্তির গায়ে তেল, সিঁদুর লেপছেন গ্রামবাসীরা। দিন দিন ভক্তের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু এ মূর্তি যে অমূল্য তা জানার পরেও হাত গুটিয়ে বসে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। এখনও পর্যন্ত সে ভাবে উদ্ধারের চেষ্টাই নেই। ভয়, মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে আঘাত পাবে ‘ভাবাবেগ’। হতে পারে রাজনীতিও। ফলে নবম বা দশম শতকের তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি ‘বিষ্ণু’ দেবতা হয়ে পুজো পাচ্ছেন পুরুলিয়ার গ্রামে। সকাল-সন্ধ্যা আরতির সঙ্গে দুপুরে ভোগও পাচ্ছেন নতুন দেবতা।
ঘটনার সূত্রপাত গত সোমবার। সকালে বরুয়াডি গ্রামের একটি জলাশয়ে (স্থানীয় ভাষায় জোড়) মূর্তিটা পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ভিড় জমাতে থাকেন গ্রামের বাসিন্দারা। ক্রমে অন্য গ্রাম থেকেও আসতে থাকেন মানুষ। সেই ভিড়ের মধ্যেই কেউ বলে দেন গ্রামে ‘ভগবান’ এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গেই ‘ভক্তি’র ধুম পড়ে যায়। মূর্তিটিকে ভাল করে স্নান (অভিষেক) করানো হয়। গায়ে লেপে দেওয়া হয় তেল, সিঁদুর। তার পরে শুরু হয়ে মূর্তি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থানের খোঁজ। পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার গোলামারায় আগে থেকেই ছিল কালভৈরবের মন্দির। সেখানেই জায়গা পান নতুন দেবতা। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া) থেকে জেলার তথ্য সংস্কৃতি দফতর— সকলেই দুর্মুল্য মূর্তি উদ্ধারের খবর পেয়েছেন। গ্রামবাসীদের হাত থেকে উদ্ধারের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা মূর্তি দিতে নারাজ। তাঁদের এক কথা, ভগবান নিজে এসেছেন গ্রামে, তাঁকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা স্কুল শিক্ষক রবীন পাণ্ডে জেলার পুরাতত্ত্ব নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘মূর্তিটি দেখে যা মনে হচ্ছে, তা পালযুগ বা তারও আগের। এই জেলায় অতীতেও এমন মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেগুলি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। এটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। এর মূল্য কোটি টাকা দিয়ে হিসাব করা যাবে না। গবেষণার জন্য এই মূর্তি অমূল্য সম্পদ।’’ তিনি জানান, একটা সময়ে পুরুলিয়া সমৃদ্ধ জৈন জনপদ ছিল। সেই সময়ের মূর্তিই হবে এটা। রবীন বলেন, ‘‘অনেক মূর্তিই গাছতলায় রেখে পুজো করা হয়। প্রশাসন উদ্ধার করতে পারেনি। এটির পরিণতিও কি তাই হতে চলেছে? যদি হয়, তবে মূর্তিটি সুরক্ষিত থাকবে কি?’’ তাঁর আশঙ্কা, এখান থেকে এই দুর্মূল্য মুর্তি তো পাচারও হয়ে যেতে পারে!
এই মূর্তির খোঁজ পেয়ে গত মঙ্গলবার ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ একটি চিঠি পাঠান রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেলের দফতরকে। মূর্তিটি সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পুরুলিয়া জেলাশাসকের কাছেও সেই চিঠির প্রতিলিপি পাঠান। আপাতত মূর্তিটি উদ্ধার করে পুরুলিয়া মফস্সল থানায় রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি কেউ। পুরুলিয়া মফস্সল থানা এবং জেলা পুলিশ সুপারের দফতরে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, এটা পুলিশের কাজ নয়। জেলাশাসক উদ্ধারের নির্দেশ দেবেন। পুলিশ প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে।
পুরুলিয়ার জেলাশাসক রজত নন্দর সঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনে সাড়া দেননি। তাঁর দফতরের পক্ষে জানিয়ে দেওয়া হয় বিষয়টি দেখছে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ। জেলাশাসক নিজেও মোবাইলে মেসেজ করে তা-ই জানান। এর পরে জেলা তথ্য-সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী জানান, মূর্তিটি উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও বাধা পেতে হচ্ছে। সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘এই এলাকায় আগেও মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। বহুমূল্য মূর্তি। অর্থ দিয়ে বিচার করা যায় না। কিছু দিন আগেই একটি বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের দফতরের অধীনে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এ সব নিয়ে কাজও করছে। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে কেউ মূর্তিটা দিতে চাইছে না। পুকুরে স্নান করিয়ে, সিঁদুর লেপে, গোবর লেপে দেওয়া হয়েছে মূর্তিটাকে।’’ ওই মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে পুরুলিয়া-২ ব্লকের বিডিও এবং পুরুলিয়া মফস্সল থানার আইসিকে গ্রামবাসীরা ঘেরাও করে রেখেছিল বলেও জানান সিদ্ধার্থ। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এমন দুর্লভ মূর্তি উদ্ধারের পরে তার স্থান কোনও সংগ্রহশালাই হওয়া উচিত।’’
কিন্তু কেন গ্রামবাসীরা দিতে চাইছেন না ওই মূর্তি? স্থানীয় তৃণমূল নেতা সিদ্ধার্থ মাহাতোর বক্তব্য, ‘‘ইতিহাসের থেকে মানুষের আবেগের গুরুত্ব বেশি। গ্রামের মানুষেরা দিনরাত হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন মূর্তির সামনে। যিনি প্রথম দেখেছিলেন তিনি সেই থেকে হবিষ্যান্ন খাচ্ছেন। সকাল, সন্ধ্যায় মানুষ আরতি দেখতে আসছেন, ভোগ দিচ্ছেন, মানত করছেন। এর কি কোনও মূল্য নেই?’’ তাই বলে এমন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন মন্দিরে স্থান পেয়ে যাবে? সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘আমি বলছি না বা আমার দলেরও বিষয় নয়। এটা মানুষের কথা। শুধু এই গ্রাম নয়, আশপাশের এলাকার মানুষও চায় মূর্তি এখানেই থাকুক। তাঁরা চাইছেন গ্রামেই পুজো হবে। দরকার হলে গ্রামেই গবেষণা, সংগ্রহশালা হোক।’’
স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ হারকিল আনসারির বক্তব্যও প্রায় এক। তিনি বলেন, ‘‘পাবলিক ওটাকে দিতে চাইছে না। গোলামারা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নবকুঞ্জ কমিটি মন্দিরের পক্ষে। কোনও একটি সংস্থা মন্দির বানিয়ে দেবে বলে কথাও দিয়েছে।’’ নবকুঞ্জের সদস্য প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমরা কেউ কেউ বুঝছি। কিন্তু সবাই তো বুঝছে না। সকলে ভক্তি ভরে পুজো করছে। সেটাকেও তো মান্যতা দিতে হবে। মানুষ আর মানুষের আবেগ নিয়েই তো সমাজ। তবে মূর্তির পাচার হওয়া বা নষ্ট হওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। একটি সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা শীঘ্রই এসে স্থায়ী মন্দির বানানোর বিষয়ে কথা বলবে।’’
পরিস্থিতি যে ক্রমশই ঘোরালো হয়ে উঠছে তা মানছেন পুরুলিয়া-২ ব্লকের বিডিও দেবজিৎ রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজে গোলামারায় গিয়েছিলাম। ঘেরাও করে রেখেছিল। গ্রামের মানুষ মনে করছেন এই মূর্তি আসার ফলে অনেক শুভ হবে। তাই তাঁরা বলছেন, জীবন দেব, কিন্তু মূর্তি দেব না।’’ তবে কি উদ্ধার করাই যাবে না? দেবজিৎ মনে করেন, সবার আগে প্রশাসনের শীর্ষ মহলকে এসে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দরকারে রাজ্য এবং জাতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কর্তাদেরও গ্রামে এসে এই মূর্তির ঐতিহাসিক মূল্য বোঝাতে হবে।
উপর মহল কবে উদ্যোগী হবেন জানা নেই। তবে এই মূর্তি যাদের হাতে থাকার কথা সেই রাজ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল দফতরের কর্তা বিপ্লব রায়ের আশঙ্কা, প্রশাসন এখনই তৎপর না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘‘দুর্গাপুজোর দ্বিতীয়ার দিনে উদ্ধার হওয়া মূর্তি পঞ্চমীতে দেবতা হিসাবে চার দিন পুজো পেয়ে গিয়েছেন। দেবীপক্ষের মধ্যেই হয়তো তিনি জাগ্রত হয়ে উঠবেন। তার পরে নতুন দেবতার নতুন মন্দিরের শিল্যান্যাসের ঘোষণও হয়তো হয়ে যাবে! ভক্তের মন্দিরে বন্দি হয়ে থাকে যাবে ইতিহাস।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এই মূর্তি জাতীয় সম্পত্তি। অবিলম্বে এটি উদ্ধারে প্রশাসনিক উদ্যোগ দরকার। সেটা না হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy