বেনেবউ, তাইগা ফ্লাইক্যাচার, ওরিয়েন্টাল পায়েড হর্নবিল, দামা, ছোট বসন্ত বউরি, আফ্রিকান সেক্রেড আইবিস (উপরে ডান দিকের কোণা থেকে ঘড়ির কাঁটার গতিপথ অনুযায়ী)। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মে মাসের এক ভোর। ঘুম ভাঙল অচেনা পাখির গানে। বারান্দায় বেরিয়ে ‘উৎসের’ খোঁজ করলাম অনেকক্ষণ। পেলাম না। পাখিটা গেয়েই চলেছে। উৎকর্ণ হয়ে গান শুনছি। বুঝলাম, একজন নয়। সঙ্গে আছে আরও কেউ। কিন্তু দেখতে পেলাম না। শব্দটা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলাম এক পাখি-পাগল বন্ধুকে। মোবাইলে পাখির নাম চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। দামা। ‘অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ’। বন্ধু লিখেছে, ‘দামা-পাখি মাটিতে ঘুরে ঘুরে পাতা উল্টে পোকা ধরে খায়। গাছে বসে গান শোনায়। সাধারণত জোড়ায় থাকে’।
ছবি দেখে খুঁজে বার করলাম। বাড়ির সামনেই একটি আবাসন তৈরি হচ্ছে। লকডাউনে কাজ বন্ধ। বড় বড় গাছ গজিয়ে গিয়েছে। গাছের পাতা পড়েছে নীচে। সেই পাতার জঙ্গলে বিকেলের দিকে বেশ কয়েকদিন কমলাটে-হলুদ পাখি দু’টির দেখা মিলল। সম্ভবত পোকা ধরে খাচ্ছিল। এর গলাই তা হলে এত সুরেলা!
দিন পনের রোজ সকালে গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছে দামা দম্পতি। কিন্তু ২১ মে সকাল থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই তাদের। আগের রাতে আমফানের ঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছে উল্টোদিকের গজিয়ে ওঠা জঙ্গল। দেবদারু, ডুমুর, জামরুল, আম, বেল, সুপারি গাছেরা জড়াজড়ি করে লুটিয়ে পড়েছে নীচে। আর দামাদের সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে বেনেবউ, বসন্ত বউরি, ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরারা।
কিছু দিন পরে বাকিরা একে একে ফিরে এলেও ফেরেনি শুধু দামারা। এখনও রোজ সকালে বারান্দায় চালিয়ে দিই মোবাইলে রেকর্ড করে রাখা দামা পাখির গান। একটানা বেজে যায়। কিন্তু ‘উত্তর’ আসে না। এ ভাবে মোবাইলে পাখির ডাক বাজালে যে সাড়া মেলে, সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল মধ্যভারতের পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানে ‘দ্য রিভারউড ফরেস্ট রিট্রিট’-এ থাকার সময়। গত অক্টোবরে গিয়েছিলাম। ফিরেছি পক্ষীপ্রেমিক হয়ে। রিট্রিটের ঘর লাগোয়া একচিলতে বারান্দা। বাঁশগাছে ঘেরা। সেই বাঁশজঙ্গলের ভিতর থেকেই আসছিল একটা পাখির ডাক। জানতাম না কী পাখি। ডাকটা রেকর্ড করলাম। চালিয়ে দিলাম। এক বার , দু’বার, তিন বার। চার বারের বেলায় বাঁশঝাড়ের মধ্য থেকে ‘জবাব’ দিল সে। বেশ কয়েকবার। টেপের শব্দ থেমে গেল। কিন্তু একেবারে সামনে ফের সেই ডাক! দেখি অদূরে কঞ্চির উপরে বসে আছে একটা পাখি। এদিক ওদিক দেখছে। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছিল বোঝার চেষ্টা করছিল বোধহয় । গাঢ় কালচে-নীল মাথা। গায়ের রং দুধ-সাদা। আর শরীরের দ্বিগুণেরও বেশি বড় লেজ। চিনতে পারলাম। ওটা দুধরাজ। ‘এশিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার’। সত্যিই যেন স্বর্গের পাখি।
আরও পড়ুন: গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বাগুইআটি থেকে উদ্ধার ২টি হাতির দাঁত
এক সকালে মোবাইলে দুধরাজের ডাক বাজাচ্ছি। ঘন ঘন সাড়া মিলছে। কিন্তু ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল নীল একটা পাখি। দোয়েলের চেয়ে একটু ছোট । মাথা হালকা নীল। বুকের কাছে রং সামান্য গাঢ়। লেজ কালচে-নীল। মুখ ঘুরিয়ে যখন বসল, মাথার পিছনে কালো টুপির মতো ছোপ স্পষ্ট দেখা গেল। একবার বাঁশঝাড়ের ভিতরে ঢুকে গেল। একটু নজর করতে দেখলাম বাঁশঝাড়ে পরিত্যক্ত বাসার উপরে বসে দোল খাচ্ছে পাখিটা। নাম ‘ব্ল্যাক নেপ্ড মোনার্ক’ বা ‘মোনার্ক ফ্লাইক্যাচার’। কিন্তু দুধরাজের ডাকে সে সাড়া দিল কেন? রিসর্টের ন্যাচারালিস্ট জানালেন, দু’টি পাখির ডাকে মিল রয়েছে। দুধরাজের ডাক বাজানোয় সম্ভবত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল মোনার্কটি।
প্রসঙ্গত, সংরক্ষিত অরণ্যের অন্দরে এ ভাবে পাখির ডাক বাজানো নিষিদ্ধ। কারণ, বার বার ‘কল প্লে’ করলে ওদের বিরক্তি উদ্রেকের সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া, দামা বা ফ্লাইক্যাচারের মতো ছোট পাখিরা রেকর্ড করা ডাকের জবাব দিতে গিয়ে বাজ জাতীয় শিকারি পাখিদের ‘নজরে’ পড়তে পারে। পেঞ্চের অভিজ্ঞতার ফল পেয়েছিলাম দামা পাখিদের আকর্ষণ করতে গিয়েও। ছন্দপতন ঘটল আমফানের পরে। তবে ‘জায়গা’ কিন্তু ফাঁকা নেই। নতুন ডালপাতা বেরনো গাছে গাছে নেচে বেড়াচ্ছে বেনেবউ-মৌটুসি-দুর্গা টুনটুনি-ফটিকজল-হরিয়াল-বুলবুলিরা। বসন্ত চলে গিয়েছে কবে। কিন্তু ভালোবাসার টানে রয়ে গিয়েছে বসন্ত বউরিরা।
আরও পড়ুন: পূর্ব মেদিনীপুরের পুকুরে তরাইয়ের কচ্ছপের বসত
কলকাতার উপকন্ঠে নরেন্দ্রপুরের এক বাগানে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একটা পাখিকে দেখলাম মাটি থেকে পাতা সরিয়ে সরিয়ে পোকা খাচ্ছে। বুকের কাছটা উজ্জ্বল কমলাটে বাদামি। ছবি তুলে পাঠালাম বন্ধুর কাছে। জবাব এল, ‘আরে এরা তো রেড থ্রোটেড ফ্লাইক্যাচার। তুই পেলি কোথায়’? এল আরও তথ্য, ‘এই পাখিদের বাড়ি রাশিয়ার তাইগা এলাকায় (সেই কারণে অন্য নাম তাইগা ফ্লাইক্যাচার)। শীতের মুখে চলে আসে ভারতীয় উপমহাদেশে। ফের চলে যায় এপ্রিলের গোড়ায়। তাই একটু অবাক হচ্ছি’। শিলিগুড়ির বন্ধু শৈবাল মিত্রও মে মাসের এক সকালে এমনই অবাক হয়েছিল ছাদে উঠে। রেলিংয়ের উপরে বসে এক জোড়া ধনেশ। ‘ওরিয়েন্টাল পায়েড হর্নবিল’। অদূরের মহানন্দা অভয়ারণ্যে ওদের দেখা মেলে প্রায়শই। তবে জঙ্গলের ঘেরাটোপ ছেড়ে তেমন একটা বেরোয় না। রাস্তায় তখন গাড়িঘোড়া প্রায় নেই। হর্নের আওয়াজ নেই। কালো ধোঁয়া নেই। তীব্র হুইসল বাজিয়ে ট্রেনের যাতায়াত নেই। পুরোদমে লকডাউন। তাই নিজস্ব গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল কেউ কেউ। ওই দু’টি ধনেশও সে ভাবেই চলে এসেছিল হিলকার্ট রোডের পাঁচতলা আবাসনের ছাদে। নিমেষে সে ছবি ভাইরাল।। শৈবালের স্ত্রী দেবযানীর আক্ষেপ, ‘‘আর কিন্তু ফিরে আসেনি ওই ধনেশরা।’’ আর হয়তো আসবেও না। লকডাউনের পর শিলিগুড়ি ফিরে গিয়েছে পুরনো চেহারায়।
মুম্বই প্রবাসী আমার এক শুভানুধ্যায়ী এক অবাক-করা ছবি পাঠিয়েছিলেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, শখের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার সোরং দালভি স্যোশাল মিডিয়ায় ছবিটি পোস্ট করার পরে পক্ষীবিশারদদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। গুজরাতের বডোদরায় ক্যামেরাবন্দি পাখিটি ‘আফ্রিকার পবিত্র আইবিস’ (আফ্রিকান সেক্রেড আইবিস)। দক্ষিণ থেকে মধ্য আফ্রিকার মধ্যেই সাধারণত দেখা যায় তাকে। কাজাখস্তান, তুরস্ক, ইরাক ও রাশিয়াতেও কালেভদ্রে দেখা গেলেও ভারতে এই প্রজাতির আইবিস দেখা যায়নি আগে। তবে এ দেশে তথা পশ্চিমবঙ্গে তিনটি প্রজাতির আইবিসের দেখা মেলে— ব্ল্যাক হেডেড, রেড-নেপ্ড এবং গ্লসি। লম্বা বাঁকানো ঠোঁটের কারণে এদের বাংলা নাম ‘কাস্তেচরা’।
আরও পড়ুন: কোদালের কোপে নিকেশ মা কেউটে, ডিম ফুটিয়ে শিশুদের ‘পুনর্বাসন’ হুগলিতে
পক্ষীবিশারদদের একাংশ মনে করছেন, আরও কয়েকটি আফ্রিকান আইবিস বডোদরার ওই অঞ্চলে এসেছে। কারণ, ওরা সাধারণত একা একা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় না। কী ভাবে পৃথিবীর এই প্রান্তে চলে এল আফ্রিকার পাখি? অনেকেই মনে করছেন, বিশ্বজুড়ে এপ্রিল-মে লকডাউন ছিল। বিমান চলাচল বন্ধ। পাখিরা নিরুপদ্রবে দূরদূরান্তে উড়ছে। সে ভাবেই ওরাও আরবসাগর পেরিয়ে ভারতে চলে এসেছে।
অবাক হওয়া যে টুকু বাকি ছিল, তা করে দেখাল আমফান। মে মাসে ওই ঝড় ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণবঙ্গে উড়িয়ে এনেছিল সুটি টার্ন, ব্রিডল্ড টার্ন, শর্ট-টেইলড শিয়ারওয়াটার, ব্রাউন নডি, গ্রেট ফ্রিগেড বার্ড, হোয়াইট-টেইলড ট্রফিকবার্ডের মতো সমুদ্রের পাখিদের। বজবজ থেকে ব্যারাকপুরের গঙ্গার উপর, দেউলটিতে রূপনারায়ণের তীরে, নিউ টাউনের আকাশে তাদের দেখা মিলেছে। কিন্তু আমফানের রেশ কাটার সপ্তাহকয়েক পরে ‘ঘরে’ ফিরে গিয়েছে ওরা। আসলে ওরা কেউই আদতে ‘পরিযায়ী’ নয়। ঝড়ের টানে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ চলে আসা।
আরও পড়ুন: ম্যানগ্রোভ কেটে তৈরি ভেড়ি, ক্ষুব্ধ আদালত
লকডাউনের কড়াকড়ি উঠতেই ‘অচেনা’ কলকাতা ছন্দে ফিরেছে। বাড়ির উল্টোদিকের আবাসন প্রকল্পের কাজ ফের তুঙ্গে। কংক্রিটের মশলামাখা মেশিন আর লোহা কাটার শব্দে হারিয়ে গিয়েছে দামার ডাক। মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলে নিঃঝুম শহরে শোনা গিয়েছে একা কোনও রাতের পাখির গান। সঙ্গী খোঁজার আকুতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy