Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Books

লকডাউনের দুর্দিনে বইপাড়াকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বাঙালি পাঠক

লকডাউনের শুরুতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল বইপাড়া। কিন্তু দ্রুত ছবিটা বদলে যায়। প্রকাশকদের একাংশ তেমনই জানাচ্ছেন। কারণ, লকডাউনের মধ্যেই শুরু হয় বই বিপণনের বিকল্প ব্যবস্থা।

লকডাউনের শুরুতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল বইপাড়া। কিন্তু দ্রুত ছবিটা বদলে যায়। —ফাইল চিত্র।

লকডাউনের শুরুতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল বইপাড়া। কিন্তু দ্রুত ছবিটা বদলে যায়। —ফাইল চিত্র।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১১:৫৩
Share: Save:

অতিমারি আর লকডাউন— দু’য়ের চাপে সব কিছুই যখন বিপর্যস্ত, বাঙালির জীবন যাপনে ‘নিউ নর্মাল’ কি অন্য কোনও বার্তা নিয়ে এসেছে? ওয়ার্ক ফ্রম হোমে নিজেকে অভ্যস্ত করতে করতে বাঙালি কি ফিরে পেয়েছে তার পড়ুয়া স্বভাব?

মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে অবকাশের বড় অংশই খেয়ে নিয়েছে টিভি সিরিয়াল অথবা সমাজমাধ্যম। আম বাঙালির জীবন থেকে অনেক দিনই উধাও লাইব্রেরি কালচার। বইপাড়ার ব্যবসা মূলত আবর্তিত হয় পাঠ্যপুস্তককে ঘিরে। সে তুলনায় গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধের বাজার অনেকটাই সংকীর্ণ। কিন্তু লকডাউনের সময় অন্য ছবিই দেখা গিয়েছে। লকডাউনের শুরুতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল বইপাড়া। কিন্তু দ্রুত ছবিটা বদলে যায়। প্রকাশকদের একাংশ তেমনই জানাচ্ছেন। কারণ, লকডাউনের মধ্যেই শুরু হয় বই বিপণনের বিকল্প ব্যবস্থা। দেখা যা, ‘বই-বিমুখ’ বদনামগ্রস্ত বাঙালি দ্রুত নিজেকে বদলে বইমুখী করে তুলছে। অনলাইনে অর্ডার থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফোন কলেও বই ডেলিভারির ব্যবস্থা করেন অনেক প্রকাশক ও বই বিপণির কর্তারা। চালু হয় অনলাইন পেমেন্ট এবং ক্যাশ অন ডেলিভারির সুবিধাও।

আনন্দ পাবলিশার্সের কমিশনিং এডিটর মলয় ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ফ্র্যাঞ্চাইজি তাঁদের সংস্থার একটা জোরের জায়গা। তা ছাড়া, ২০২০-র ১৭ সেপ্টেম্বর আনন্দ পাবলিশার্স তাদের ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ চালু করে। ই-বুকের পাশাপাশি সেখানে হার্ড কপিও অর্ডার করা যায়। কোনও ন্যূনতম ক্রয়সীমা না থাকায় এবং যে কোনও মূল্যের কেনাকাটাতেই ফ্রি শিপিংয়ের ব্যবস্থা পাঠকদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই বেড়ে যায় বিক্রি। লক্ষণীয় যে, এই লকডাউন পর্বে উল্লেখযোগ্য বিক্রি বাড়ে নন ফিকশনের। মলয় জানালেন, এমন অনেক বই ছিল, যা প্রিন্ট ক্যাটালগে পাঠকের চোখ এড়িয়ে যেত। সেই সমস্ত বই এ বার ওয়েবসাইটের দৌলতে পাঠকের নজর কাড়ছে। লকডাউন পর্বে উল্লেখযোগ্য ভাবে বিক্রি হয়েছে ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’, ‘মার্ক্স ২০০’ বা ‘জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর’-এর মতো নিবন্ধগ্রন্থ।

আরও পড়ুন: ‘মরণোন্মুখ’ বাঙালিকে শিল্প ও বাণিজ্যমুখী করতে পরিবর্তন চাই

আরও পড়ুন: আনন্দবাজার ডিজিটালের বিচারে ২০২০ সালের সেরা ১০টি বই

কলকাতার অন্যতম বৃহৎ পুস্তক বিপণি দে’জ পাবলিশিংয়ের তরফে শুভঙ্কর দে জানাচ্ছেন, লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পরে বই বিক্রি সঙ্কটে পড়েছিল। কিন্তু ক’দিন পেরতেই ছবিটা বদলাতে শুরু করে। মে মাসের ৫ তারিখের পর থেকে দে’জ-এর তরফে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে বই পোঁছে দেওয়া হচ্ছিল। পরে ডাক পরিষেবা চালু হলে স্পিড পোস্টের মাধ্যমে বই ডেলিভারি দেওয়া শুরু হয়। শুভঙ্করের মতে, সেই পর্বে বইয়ের বিক্রি সাধারণ সময়ের প্রায় ৫ গুণ বেড়ে গিয়েছে। সব রকমের বই-ই পাঠক চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, শুধু দে’জ-এর বই নয়, অন্য প্রকাশনের বইয়ের চাহিদাও ছিল বিপুল। কলেজ স্ট্রিট বন্ধ থাকায় আড্ডা জমেনি পরিচিত বই বিপণি ও আড্ডাপীঠ ধ্যানবিন্দু-তে। কিন্তু লকডাউনের ধাক্কা প্রাথমিক ভাবে সামলে ওঠার পরেই রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় বিপণির সঙ্গে যুক্ত সকলকে। সংস্থার কর্ণধার অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, জুন মাস থেকে ফোনে অর্ডার নেওয়া শুরু করে ধ্যানবিন্দু। সাইকেলে করে ডেলিভারির ব্যবস্থাও করা হয়। ফেসবুক মারফত সব থেকে বেশি সাড়া পাওয়া যায়। অভীকের মতে, সাধারণ সময়ে আর লকডাউনে খুব বেশি প্রভেদ দেখা যায়নি বিক্রিবাটায়। ওই আউটলেট থেকে নন ফিকশনের বিক্রি হয়েছে ভাল। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ধ্যানবিন্দু থেকে বেশি বিক্রি হয় প্রবন্ধ বা কবিতার বই।

লকডাউন আর কিছু না করুক, একটা লক্ষণীয় অংশের বাংলাভাষীকে বইমুখী করেছে। —ফাইল চিত্র।

সোদপুরের বইয়ের দোকান পাপাঙ্গুলের ঘর-এর কর্ণধার জয়দীপ মিত্র যেমন বললেন, ফেসবুক থেকে নিয়মিত পাঠকের সাড়া পান তাঁরা। ফলে তাঁর দোকানের বিক্রির ব্যাপারটা অনেকটাই অন্য রকম। লকডাউনের পর জুন মাস নাগাদ পাপাঙ্গুলের ঘর খোলে। ফেসবুকে জয়দীপ জানান, বালি থেকে ব্যারাকপুর অঞ্চলে তিনি সাইকেলে করে বই ডেলিভারির ব্যবস্থা করেছেন। নিজেই সাইকেলে করে বই পৌঁছে দিতে থাকেন পাঠকদের চাহিদা মাফিক বই। সঙ্গে ক্যাশ অন ডেলিভারির ব্যবস্থাও। স্বাভাবিক সময়ের থেকে অনেক বেশি সাড়া মেলে এই পর্বে। জয়দীপের অভিজ্ঞতা বলে, লকডাউনে পাঠক বেশি করে কিনেছেন নন ফিকশন।

ফলে লকডাউন আর কিছু না করুক, একটা লক্ষণীয় অংশের বাংলাভাষীকে বইমুখী করেছে। এর পিছনে সম্ভবত ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ক্লান্তি দূর করতে গিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার তাগিদ থেকে থাকবে। কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল সময়। অফিস যাতায়াত করতে যে সময়টা লাগে, লকডাউন আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম সেই সময়টা বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এক দিকে যেমন চাহিদা বেড়েছে ওয়েব সিরিজের, তেমনই মন আর মগজের খিদে মেটাতে অনেকে আশ্রয় খুঁজেছেন ছাপার অক্ষরে। তবে নন ফিকশনের চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টাও ভাবার। যা থেকে এই প্রশ্ন অনিবার্য যে, সাম্প্রতিক বাংলা গল্প-উপন্যাসে কি মনের খিদে মিটছে না বাঙালি পাঠকের? এই মুহূর্তে বাঙালি পাঠক মাত্রেই কি সিরিয়াস? লঘু বিনোদনের জন্য যাঁরা গল্প-উপন্যাস পড়তেন, তাঁদের স্রোতটা কি বেঁকে গিয়েছে টেলিপাড়ার দিকে?

তবে করোনা এবং লকডাউনে যখন অন্য ব্যবসার নাভিশ্বাস উঠেছে, তখন বইপাড়ার ছবিটা আশাব্যঞ্জক। এই দুর্দিনেও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে পড়ুয়া বাঙালি।

অন্য বিষয়গুলি:

Books Lockdown Pandemic Bengali Reader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy