ভাঁটফুল। ছবি: বিকাশ মশান
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে সবচেয়ে সুন্দর করুণ-সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে থাকে মধুকূপি ঘাসে অবিরল’—জীবনানন্দের জগতে নাগরিক কোলাহল যখন ক্লান্ত করে, মধুকূপি ঘাস ঘাম মুছিয়ে সময়ে-অসময়ে দু’দণ্ড শান্তি দেয়। কিন্তু কোন ঘাসের নাম মধুকূপি, চেনা না থাকলে শুধু কল্পনা ভরসা। ঘাসের বেলায় তবু একটা সুবিধা। রঙে-রূপে চিত্রকল্প তৈরি হয়েই রয়েছে। কবিতার রসাস্বাদনে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যখন পড়া হয়, ‘শাদা ভাটপুষ্পের তোড়া/আলোকলতার পাশে দ্রোণফুল গন্ধ ঢালে বাসকের গায়’—দু’লাইনে চারটি ফুললতার নাম—যারা সবার চেনা নয়। গোলাপ, রজনীগন্ধার মতো অভিজাত বা জবা, টগরের মতো আটপৌরেও নয়, তাদের চিনতে না পারায় অস্বস্তি হতেই পারে অনেকের।
বাংলার অনাদরের এ সব ঝোপঝাড়, আগাছা জীবনানন্দ দাশের কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে। কবিতার নিস্তব্ধ আবহে যেন বেহালায় মাঝে মাঝে করুণ সুরের ছড় টানে। সে সুর তারই বুকে মোচড় দেয় যে ফাল্গুন-চৈত্রে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ভাঁটফুলে মাঠঘাট ছেয়ে থাকতে দেখেছে। ডাঁটি ঘিরে মন্দিরের চুড়োর মতো বিন্যাসে উপচে পড়া সাদা ফুল। সরু সরু কেশর ঠিক যেন বাহারি লেসের সুতো। গুচ্ছ থেকে একটা ফুল হাতে নিয়ে দেখলে মনে পড়তেই পারে বেহুলার কথা। সেই যে—‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় ’। জীবনানন্দের ভাঁটফুলই কিন্তু বিভূতিভূষণের ঘেঁটু। দুই বাংলার আঞ্চলিক নামের হেরফের।
স্বর্ণলতাই ওপার বাংলায় আলোকলতা। সোনালি হলুদ পত্রবিহীন পরগাছা। সুযোগ পেলেই হেথাহোথা অন্য গাছের গায়ে চামর দোলায়। দ্রোণপুষ্প দু’ধরনের। লাল এবং সাদা। এক-দেড় ফুট লম্বা গাছ। অনেকটা দোপাটি গাছের আকার। বল্লমের ফলার মতো পাতা। নরম কাণ্ড থেকে খুদে খুদে মুখ হাঁ করা ফুল। শ্বেতদ্রোণ যখন বিস্তীর্ণ মাঠে ফুটে থাকে, ভ্রম হয় বুঝি বা অজস্র সাদা খই ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। তাই এর আরেক নাম খই ফুল। এ কথাটা জানার আগে ‘আমি যদি হতাম বনহংস’ কবিতার প্রাকৃতিক দৃশ্যপট কল্পনা করা কঠিন। ‘তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন/নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা’।
খই ফুল চেনার আগে বার বার ভেবেছি কবি কি ধানখেত বোঝাতে চেয়েছেন? তা হলে ধানের শিষের প্রায় চোখে পড়ে না এমন ফুলের সঙ্গে তারার তুলনা কেন? এত দুর্বল উপমা! খই ফুল চেনার পরে কবিতাটি আমার কাছে যেন নতুন মাত্রা পেল! এই দ্রোণ ফুল যে বাসকের ‘গায়ে গন্ধ ঢালে’, সেই বাসককে সবাই চেনে কবিরাজি গুণে। তারও ফুল ফোটে। সাদা ফুল সবুজ বৃতি থেকে ইতিউতি উঁকি মারে।
দ্রোণ ফুল অনেক দিন দেখিনি। যেমন বহু বছর উধাও নাটাফল। শুধু গ্রামে নয়, শৈশবের মফস্সল শহরের এ দিক-ও দিক ভরে থাকত নাটার ঝোপে। ছোট ছোট সবুজ কাঁচা নাটা ফল ডানপিটেদের কোঁচড়ে দিব্যি খেলার গুলি হয়ে যেত। পাকা নাটার লাল রং জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলায় বার বার ফিরে ফিরে আসে—‘সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মত জাগিছে অরুণ’ অথবা ‘নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ /দু’মুহূর্ত ভরে রাখে -তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস ’।
নিতান্ত অকাজের ভেরেন্ডা গাছ মাথা উঁচিয়ে গজিয়ে ওঠে পথের ধারে ফাঁকা জমিতে। তাকেও মায়া-কাজল পরিয়েছে কবিতা। ‘এ সবুজঘাসের ভিতর সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে—কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেন্ডা ফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে’। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যায়, ভেরেন্ডার ছোট্ট লাল ফুল আর সবুজ ফলের মধ্যে বীজগুলো ঠিক যেন ‘মিনিয়েচার’ মাপের চোখ-নাক-মুখ আঁকা রাজকন্যা পুতুল! ভেরেন্ডার পরে—‘আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ’ । শিবঠাকুরের পছন্দের ফুল বলে সবাই
চেনে আকন্দকে। সে জন্যই দোকানেও বিকোয় আকন্দফুল।
‘যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়—সে তো আর ফিরে নাহি আসে;/ কাঞ্চনমালা যে কবে ঝরে গেছে;—বনে আজো কলমীর ফুল/ ফুটে যায়..’ — বনকলমি বা দুধকলমি তার হালকা বেগুনি ফুলের পসরা সাজিয়ে অবহেলায় পথের ধারে ফুটে থাকে। আজও শত ঝাঁ চকচকে উন্নয়নের হাতও তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বনকলমির সেই আবহমান কাল ধরে ‘ফুটে থাকা’কে এক বিশেষ মাত্রা দেন জীবনানন্দ—‘নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে...../ তারাবনে পড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল, / বিশুষ্ক পদ্মের দীঘি- ফোঁপরা মহলা ঘাট, হাজার মহাল/ মৃত সব রূপসীরা’। জাঁকজমকপূর্ণ অভিজাত স্থাপত্য ভেঙে পড়ে কিন্তু বনকলমি বা তার মতো অন্তেবাসী আগাছারা অনাদরে ফুল ফুটিয়ে যায়। কত দিন ফোটাতে পারবে কে জানে? দু’বছর কলি ফেরানো হয়নি এমন বাড়ি দেখলেই আজকাল প্রোমোটার হাত বাড়ায়। পোড়োবাড়ি, ভাঙা দেউল বিলুপ্তপ্রায় সাজানো বাগানে এদের প্রবেশ নিষেধ! তা হলে ভাট, বনকলমি, দ্রোণ—এরা ফুটবে কোথায়! কয়েক দশক পরে ‘রূপসী বাংলা’র গভীর নির্জন আলোকময় বিষাদ কি পাঠকের হৃদয়ের ঠিক জায়গাটা ছুঁতে পারবে? কারণ, জীবনানন্দের রূপকল্পের রসদেরা হয়তো ততদিনে গায়েব।
লেখক চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy