প্রতীকী ছবি।
রাজ্য জুড়ে ডাক্তারদের এই আন্দোলন হয়তো কয়েক দিনের মধ্যে মিটে যাবে। কিন্তু যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূত্রপাত, তা কি আদৌ মিটবে?
মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, জুনিয়র ডাক্তাররা রাজনীতি করছেন, তাই তাঁদের প্রথমে হুঁশিয়ারি দিয়ে, পরে আবেদন করে কাজে ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। আর জুনিয়র ডাক্তারেরা বদ্ধপরিকর, মুখ্যমন্ত্রীকে ‘অহং’ ভেঙে আসতে হবে আন্দোলনকারীদের কাছে। কিন্তু তিনি যদি আসেনও, কর্মবিরতি যদি উঠেও যায়, তা হলেও কি নিশ্চয়তা আছে যে আগামী দিনে ফের কোনও ডাক্তার মার খাবেন না? শুধু পুলিশ বাড়িয়ে ডাক্তারদের নিরাপদ রাখা সম্ভব? সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা বহু বছর যুক্ত, তাঁরা বলছেন, বিপরীত আশঙ্কাই বেশি।
বস্তুত আন্দোলন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল সমস্যা। প্রবীণ চিকিৎসকদের বড় অংশই মনে করছেন, গোড়ার গলদ সামনে আসছে না। সরকারি হাসপাতালের ইনডোর এবং আউটডোরের ৮০ শতাংশেরও বেশি দায়িত্ব সামলান জুনিয়র ডাক্তারেরা। যে কোনও পরিস্থিতিতে রোগীর পরিবারের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদেরই। তাই ইমার্জেন্সি চিকিৎসার পরিকাঠামোয় বদল না এলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কমবে না। প্রবীণ চিকিৎসকেরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা ডাক্তারের গায়ে হাত তুলছেন, তাঁরা সবাই গুন্ডা নন। কোন পরিস্থিতি রাতারাতি তাঁদের গুন্ডা তৈরি করছে, সেটা আগে বোঝা দরকার।
অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে ‘ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’ তৈরি হয়েছে। ইমার্জেন্সি রোগীকে সেখানে ভর্তি রেখে চিকিৎসা শুরু করার কথা। পরে তাঁর অবস্থা বুঝে অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর কিংবা ছুটি দেওয়ার কথা। আদতে কী হয়? ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, কিছু নেতার ‘ক্যাচ’-এর হার্নিয়া বা অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারের রোগী ভর্তি হন। অথচ দুর্ঘটনার
পরে গুরুতর আহত এসে শয্যা পান না। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে কোনও জুনিয়র ডাক্তার যখন ট্রলিতে বসে থাকা সেই দুর্ঘটনাগ্রস্তের ড্রেসিং করতে যান, তত ক্ষণে রোগী অচেতন। পরিজনেরা ধরে নেন, ডাক্তারই এর জন্য দায়ী।
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক আরএমও-র অভিজ্ঞতা জানা যাক। শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার (এই আন্দোলন চলাকালীন যাঁকে মেডিক্যাল কলেজ থেকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা) সুপারিশের রোগী এসেছিলেন ভর্তি হওয়ার জন্য। তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চান ওই আরএমও। তাঁকে রোগী বলেন, ‘‘ভর্তি করতে বলা হয়েছে, করুন। অত কথার দরকার নেই।’’ আরএমও প্রতিবাদ করলে তাঁর সিনিয়রের কাছে ফোন আসে সেই প্রভাবশালীর। চার অক্ষরের কটূক্তিসমেত বলা হয়, ১০ মিনিটের মধ্যে রোগীকে ভর্তি না-করলে সন্ধ্যায় তাঁদের দুজনেরই পোস্টিং হবে পাথরপ্রতিমায়। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, ‘ক্যাচের’ রোগীকে পরিষেবা দিতেই তাঁদের অনেকটা সময় কেটে যায়।
এঁদের ‘ক্যাচের পেশেন্ট’ কেন বলা হয়? এক ডাক্তার বলেন, ‘‘এঁরা কোনও নেতা বা মন্ত্রীকে ক্যাচ করেন বা ধরে নেন। তাই ক্যাচের পেশেন্ট। ভর্তি, পরীক্ষানিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার, সবেতেই এঁদের অগ্রাধিকার। মুমূর্ষু রোগীর অবস্থা খারাপ হলে হোক, ক্যাচের রোগীকে দেখতেই হবে। না হলে চাকরি খোয়ানো অনিবার্য। এক শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের সিদ্ধান্ত শেষ কথা, নাকি নেতার নির্দেশ, ফয়সালার সময় এসেছে।’’
হাসপাতালে এসে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চাহিদা কী থাকে? রোগী আগে শয্যা পাক। তাঁর চিকিৎসা সময় মতো শুরু হোক। বাস্তবে কী হয়? ইমার্জেন্সির ডাক্তার দেখে হয়তো বলেন, প্লাস্টিক সার্জারিতে যেতে হবে। প্লাস্টিক সার্জারিতে যাওয়ার পরে বলা হয়, কার্ডিওথোরাসিকের ডাক্তারদের মতামত প্রয়োজন। সেখানকার ডাক্তার বললেন, এটা কার্ডিওথোরাসিকের বিষয়ই নয়। অর্থোপেডিক-এ যান। এক ওয়ার্ড থেকে আর এক ওয়ার্ডে ঘুরতে ঘুরতে রোগীর অবস্থা ক্রমশ সঙ্গীন হতে থাকে। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, ‘‘সর্বত্র যখন ইমার্জেন্সি পরিষেবাকে অন্য পরিষেবার সঙ্গে এক ছাতার তলায় আনা হচ্ছে, তখন এখানে কেন কয়েক জন ডাক্তার ইমার্জেন্সি নামক ঘেরা জায়গায় বসে থাকবেন, আর বাইরে ৪০ জন লোক প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে যাবে, কখন তাঁদের রোগী বেড পাবেন? প্রাথমিক স্তরের পরিকাঠামো তৈরি করাই সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি ‘ম্যান পাওয়ার’ এর যথাযথ ব্যবহার না-হলে সমস্যা মিটবে না।’’
চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ধরা যাক, আমার বাবাকে ভর্তি করতে হাসপাতালে গেলাম। আমার বয়স ৬৫। বাবার ৯০। হাসপাতালে ট্রলি নেই। ঘুষ দিয়ে একটা ট্রলি যদিও বা জোগাড় হল, তা ঠেলার লোক নেই। আমি এই বয়সে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যেতে পারব না। ট্রলি ঠেলার জন্যও আমাকে বখশিস দিয়ে লোক জোগাড় করতে হল। তার পরে ওয়ার্ডে গিয়ে অপেক্ষা, ভোগান্তি তো আছেই। এই গোটা সময়টা আমার মধ্যে যে তিক্ততা তৈরি হল, তা আমি কোথায় উগরে দেব?’’
বহু আগে সরকারি হাসপাতালে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসারের পদ ছিল। রোগী বা তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার দায়িত্ব ছিল সেই সব অফিসারদের উপরে। বাম আমলেই সেই পদ উঠে যায়। তৃণমূলের আমলে চুক্তির ভিত্তিতে ‘রোগী-বন্ধু’ নেওয়া শুরু হয়েছিল। সেও চুকেবুকে গেছে।
প্রবীণ চিকিৎসকদের এক অংশ বলছেন, স্রেফ চমক তৈরির জন্য জেলায় জেলায় খোলা হয়েছিল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। চিকিৎসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্ড সই করিয়ে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। তার পর? যেখানে রোগী আছেন, সেখানে ডাক্তার নেই। যেখানে ডাক্তার আছেন, সেখানে রোগী নেই। প্রত্যন্ত জেলার এক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন জানিয়েছেন, নখকুনির রোগী দেখে দিন কাটছে তাঁর। কার্ডিওথোরাসিক সার্জনের সময় কাটছে চোখের সমস্যার রোগী দেখে। অথচ কলকাতা বা তার আশপাশের মেডিক্যাল কলেজ থেকে ওই সব বিভাগে ডাক্তার তুলে নেওয়া হয়েছে। সেখানে এক-একজন ডাক্তার রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জেলায় একজন ডাক্তার সামলাচ্ছেন ৪০০ জন রোগী।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলছেন আউটডোরের পরিস্থিতি নিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কোনও সভ্য দেশে আউটডোরের এই অবস্থা থাকে? আমার আউটডোরে আট জন ডাক্তার। ১২০০ রোগী হয়। শুধু তাঁদের ব্লাড প্রেশার, ওজন মাপতেই কত সময় লাগে সেটা ভাবুন। তার পরে তো আসল চিকিৎসা। কী ভাবে দিনের পর দিন তা সামলাবেন এক জন ডাক্তার?’’
তবু ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ে না। যাঁরা আছেন, তাঁরা তিতিবিরক্ত হয়ে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে মেডিক্যাল কলেজগুলির গেট তৈরি হয়, কিন্তু ইমার্জেন্সিতে শয্যা বাড়ে না। মূল্যবান ওষুধ সরবরাহ হয়, অথচ প্রাথমিক স্তরে অক্সিজেন-স্যালাইনের জোগানে ঘাটতি থাকে। জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন কিনতে রোগীর পরিবারকে ছুটতে হয় বাইরের দোকানে। ক্ষোভ জমতে থাকে আম জনতার মনে।
হাসপাতাল চত্বরে ফুলগাছের টব বসে। দিনের শেষে মার খান ডাক্তারেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy