সুনসান মেডিক্যাল কলেজ চত্বর। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
সরকারি হাসপাতালের অচলাবস্থা এক দিকে যেমন অজস্র প্রশাসনিক ত্রুটির কথা সামনে আনছে, তেমনই সামনে আনছে আরও একটি জরুরি প্রশ্ন। রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আর কত দিন পার পাবেন এক শ্রেণির ডাক্তার?
এক জন মুমূর্ষু রোগীর পরিবারের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয়, কী ভাবে কোনও মৃত্যুসংবাদ জানাতে হয় তাঁর পরিজনকে, সেই শিক্ষা কেন গুরুত্ব পাবে না? একটা মৃত্যু হয়তো সেই চিকিৎসকের পেশাগত জীবনে ২০০ বা ৫০০ নম্বর। কিন্তু মৃতের পরিবারের কাছে তো তা নয়। তা হলে সেই পরিবারকে ওই সংবাদটি কী ভাবে দেওয়া উচিত, তা কেন শিখবেন না ডাক্তাররা? সামান্য সৌজন্যমূলক ব্যবহার কেন বহু ডাক্তারের কাছেই প্রত্যাশা করা যাবে না? রোগীর পরিবারের কেউ মেজাজ হারালে কেন সেই রোগীর মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময়ে শর্ত দেওয়া হবে, ‘‘আগে পায়ে ধরে ক্ষমা চান, তার পর সার্টিফিকেট লিখব?’’
কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা বললেন, ‘‘যে চাপের মুখে আমাদের কাজ করতে হয়, তাতে সব সময় ভাল ব্যবহার সম্ভব নয়। আউটডোরে কয়েকশো রোগী, ইনডোরে শয্যা ছাড়িয়ে ভরে উঠছে মেঝে। ইমার্জেন্সিতে রোগী পিছু ১০/১৫ জন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন। এর পরেও ভাল ব্যবহার?’’
সঙ্গত যুক্তি। কিন্তু ওয়ার্ডে এক টেবিল থেকে আর এক টেবিলে কেউ হয়তো ছুটে বেড়াচ্ছেন বেডে কাতরানো তাঁর স্বজনকে যাতে ডাক্তার একটি বার দেখেন সেই জন্য, তখন সেই ডাক্তার বলছেন, ‘‘আমি কেন যাব? উনি তো আমার আন্ডারে ভর্তি নন!’’ কিংবা মোবাইলের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে কেউ বলছেন, ‘‘একেবারে শেষ করেই তো এনেছেন। এখন আর আমাদের দু’পাঁচ মিনিট দেরিতে কী এসে যায়?’’ তখন সেই মুহূর্তে অন্য প্রান্তে থাকা মানুষটির মনের অবস্থা কী হতে পারে?
আরও পড়ুন: রাজ্যে চিকিৎসা-সঙ্কট কাটার সম্ভাবনা, আজ মুখোমুখি বৈঠক হতে পারে নবান্নেই
সবাই এ রকম করেন না, সে কথা যেমন ঠিক। তেমনই কেউ কেউ করেন, সেটাও তো সমান ঠিক। বহু ডাক্তার পর্যন্ত দেন না, এতটাই অসম্মান, এতটাই অবজ্ঞা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন আর রোগীর বাড়ির লোক তাঁর পিছনে পিছনে দৌড়চ্ছেন— এই দৃশ্য তো সকলেরই চেনা। আজ যত সিনিয়র চিকিৎসক জুনিয়রদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, সমর্থন করে নিজেরাও কাজ বন্ধ রেখেছেন, তাঁদের কেউ কেউ কি একবারও অনুজপ্রতিমের কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, ‘‘তোমাদের দাবিদাওয়া খুব সঙ্গত। কিন্তু তোমরাও একটা কথা মাথায় রেখো, যে মানুষটা বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের কাছে আসছেন, তাঁর কাছে আমাদের চেয়ে বড় আশ্রয় আর কেউ নেই।’’ ডাক্তারির পেশায় কখনও কখনও একটু ভাল ব্যবহার তো ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ দেয়।
গোটা বিশ্ব জুড়েই কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে ডাক্তারদের আচরণের বিষয়টি। শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানালেন, ইংল্যান্ডে শুধু পরীক্ষার নম্বর নয়, বিচার্য হয় মেডিক্যাল পড়ুয়ার 'অ্যাটিটিউড'-ও। ডাক্তার হওয়ার মানসিকতা তাঁর কতটা আছে, সেটা যাচাই করা হয়। পাশাপাশি তাঁর সংযোজন, ‘‘এখানে রোগী-ডাক্তারের অনুপাতটাই এমন যে, অস্বাভাবিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। ডাক্তারও তো একজন রক্তমাংসের মানুষ। কতটা সইতে পারবেন তিনি!’’
স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা জানিয়েছেন, পরপর অজস্র অভিযোগ আসতে থাকায় সম্প্রতি ডাক্তারদের ব্যবহারের পাঠ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে তা বিচ্ছিন্ন ভাবে। আর সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে সেই পাঠের ক্ষেত্রে নাকি উৎসাহের ঘাটতিও প্রবল!
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বললেন, ‘‘আমি বারবার ছাত্রছাত্রীদের বলি, তোমরা নিজেদের ভগবান মনে না করে সার্ভিস প্রোভাইডার মনে করো। রোগীদের পরিষেবা দেওয়াটা তোমার চাকরি। আজ যেমন কোনও দোকানদার ক্রেতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাঁর ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, তেমনই ডাক্তারও রোগীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাঁর চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। এটা বুঝে গেলেই আর কোনও জটিলতা থাকবে না।’’
এনআরএস চত্বরে দাঁড়িয়ে সেখানকারই এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘আগে তো এতটা ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, ডাক্তারদের একাংশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তত বাড়ছে। আসলে বিষবৃক্ষের চারা পুঁতলে এই ফলই তো হবে। সবাই বুঝে গিয়েছেন, যা-ই করি না কেন, পার পেয়ে যাব। চিকিৎসায় গাফিলতি হোক, কাজ বন্ধ রেখে আন্দোলন হোক কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া না দেওয়া হোক। কিছুতেই কোনও শাস্তি হবে না।’’
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফে ডাক্তারদের ‘সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট’-এর কয়েকটি প্রশিক্ষণ হয়েছে। পাঠ্যক্রমে এর অন্তর্ভুক্তি যে জরুরি, তা মানছেন সংগঠনের নেতারাও। পাশাপাশি সংগঠনের তরফে চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘বিদেশে ৩ ঘণ্টায় ১২ থেকে বড়জোর ১৫ জন রোগী দেখতাম। নইলে বলা হত, রোগীর প্রতি সুবিচার করা যাবে না। এখানে ৩০ জন পর্যন্ত মাথা ঠিক রাখা যায়। তার পর আস্তে আস্তে কী দেখছি, কাকে দেখছি সব গুলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তার পরেও ডাক্তাররা খারাপ ব্যবহার করেন, সেটা মানতে পারব না।’’ এই মানা-না মানার বিতর্কের মধ্যেই আন্দোলনরত ডাক্তারদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অগণিত অসুস্থ মানুষ। প্রতিনিয়ত হাজারো ভোগান্তি সহ্য করার পরেও তাঁদের অনেকেই ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। আগামী দিনে কাজে ফেরার পরেও সরকারি-বেসরকারি স্তরে কিছু ডাক্তারের তরফে এমন অসৌজন্য চলতে থাকলে তাঁদের মনে কিন্তু স্থায়ী ঘৃণা জন্ম নেবে। সেই ঘৃণার ভার বইতে পারবেন তো ডাক্তাররা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy