বাংলার ভেটকি মাছ আর মিষ্টি দই খেয়ে বিধানসভা ভোটের বছরখানেক আগে রাজ্যে দলকে চাঙ্গা করতে চেয়েছেন রাহুল গাঁধী। কিন্তু তাঁর মিষ্টি দইয়ের রেশ কাটার আগেই কড়া কফির তিক্ততায় ফের ডুবে গিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস!
রাহুলের উপস্থিতিতে উজ্জীবিত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কথা দিয়ে ফেলেছেন, আজ হোক বা কাল, তাঁর হাতে বাংলা উপহার দেবে কংগ্রেস! কিন্তু রাহুল কলকাতা ছা়ড়তেই তাঁর সফরের সময় নিজেদের ‘অসম্মানে’ ক্ষুব্ধ প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতারা বসে পড়েছেন ঘুঁটি সাজাতে। আর ক্ষুব্ধ প্রদেশ সভাপতি হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, দলের মধ্যে এমন বিশৃঙ্খলা তিনি বরদাস্ত করবেন না!
গোষ্ঠী-রাজনীতি সঙ্গে নিয়েও এ বার সাম্প্রতিক পুরভোটে মুখরক্ষা হয়েছে কংগ্রেসের। কিন্তু দলে ভাঙন বন্ধ হয়নি। কাটোয়ার রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সুজাপুরের আবু নাসের (লেবু) খান চৌধুরী তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩১। দক্ষিণবঙ্গে রয়েছেন খড়গপুরের প্রবীণ জ্ঞানসিংহ সোহনপাল (চাচা), সবংয়ের মানস ভুঁইয়া, ঝালদার নেপাল মাহাতো এবং আমতার অসিত মিত্র! মালদহেও ভাঙন স্পষ্ট। এমতাবস্থায় রাহুলের সফর পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করেছে বলেই দলীয় সূত্রে খবর!
শনিবার বিকালে রাহুল যখন দিল্লির উড়ান ধরতে যাচ্ছেন, প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা তখন বসেছিলেন পার্ক স্ট্রিটের এক সাবেক কাফে কাম কনফেকশনারি শপে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরের দুর্দশার ময়না তদন্ত করতে গিয়ে সেই কফির আসরে ক্ষোভ উছলে পড়েছে প্রদেশ সভাপতির বিরুদ্ধেই। তিন প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি সোমেন মিত্র, মানস, প্রদীপ ভট্টাচার্য, দুই সাংসদ আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরী ও তাঁর ভাগ্নি মৌসম বেনজির নূর, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সিরা ঘরোয়া আসরেই নিজেদের যন্ত্রণার বৃত্তান্ত ভাগ করে নিয়েছেন। ভবিষ্যতের প্রশ্নে রাজ্য কংগ্রেসে এখন তিনটি মতের জন্য তিনটি শিবির! এক দল মনে করে, পুরনো তিক্ততা ঝেড়ে ফেলে ২০১৬-য় ফের তৃণমূলের হাত ধরা উচিত। দ্বিতীয় শিবির চায়, বামেদের সঙ্গে পরোক্ষে সমঝোতা হোক। আর তৃতীয় শিবিরের মতে, একলাই চলা উচিত কংগ্রেসের। তবু প্রদেশের সব অনেক নেতাই একটি প্রশ্নে একমত— দলে তাঁদের মর্যাদা নেই!
শনিবারের ওই আসরে অবশ্য অনুপস্থিতি ছিলেন প্রদেশ সভাপতি অধীর এবং অধুনা অধীরের কট্টর বিরোধী আব্দুল মান্নান! একে তো রাহুলের বক্তৃতায় সারদা-কাণ্ডের নামোল্লেখ ছিল না। উপরন্তু তাঁর বাড়ির পাশে রিষড়ার চটকলে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন অথচ মান্নানের আমন্ত্রণ নেই, এমন ঘটনাও ঘটেছে! মান্নানের কথায়, ‘‘আমায় না ডাকলে কেন যাব? রিষড়ায় রাহুলের অনুষ্ঠানে কারা থাকবেন, দলের তরফে করে দেওয়া তার তালিকায় আমার নামও ছিল না। তার পরেও আমি গেলে তো এসপিজি বার করে দিত!’’ হুগলি জেলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ নাথ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘‘যে ভাবে প্রতিদিন অসম্মান করা হচ্ছে, মান্নানদা বলেই এখনও কংগ্রেসটা ছা়ড়েনি!’’
কর্মিসভায় মানসবাবুর বক্তৃতা না করাও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে দলের মধ্যে। রাহুলকে সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ জানিয়েই বসে পড়েছিলেন মানসবাবু। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি বিধানসভা ভোটের আগে জোট হবে কি হবে না, তা নিয়ে হাইকম্যান্ডের স্পষ্ট বার্তা আসার আগে রাহুলের সামনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর চ়ড়াবেন না বলেই বক্তৃতা এড়িয়ে গেলেন এই বর্ষীয়ান নেতা? মানসবাবুর অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘‘রাহুল গাঁধীকে বসিয়ে রেখে বক্তৃতা করার মানে হয় না! তা ছাড়া, প্রদেশ কংগ্রেসের তরফে বক্তৃতার দু’মিনিট সময় নির্ধারিত হয়েছিল। দু’মিনিটে কী কাজের কথা বলা যায়!’’ রাহুলের সভা শুরুর আগে থেকেই যে সুর এমন কাটতে শুরু করেছিল, সেই নেপথ্য সঙ্গীত সঙ্গে নিয়েই পরে বসেছিল কফির আসর!
যে খবর পেয়ে রবিবার প্রদেশ সভাপতি অধীর বলছেন— ‘‘প্রদেশ নেতারা কোথায় কী করছেন, সে সব নিয়ে একটুও উৎসাহিত নই। তবে কিছু বলার থাকলে ওঁরা আমার কাছে আসতে পারতেন! অধীর চৌধুরী যত দিন প্রদেশ সভাপতি আছে, দলে থেকে বিশৃঙ্খলা চলবে না!’’ তাঁর কথায়, ‘‘বিধানসভা এখন তৃণমূল ভবন হয়ে গিয়েছে! আগের পাঁচ দলত্যাগী বিধায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবু রবিবাবু ও লেবুবাবুর বিধায়ক পদ খারিজের জন্য স্পিকারকে চিঠি দেবে পরিষদীয় দল।’’ অধীরের আরও সংযোজন, ‘‘একটা কারণে আমি হুমায়ুন কবীরকে সম্মান করি। দল ছা়ড়ার সময় নৈতিকতার খাতিরে সে অন্তত বিধায়ক পদটাও ছেড়ে দিয়েছিল!’’
দলেরই একাংশ অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, কংগ্রেসের হাল যা, পরে আর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কেউ থাকবে তো? এক নেতার কথায়, ‘‘নেতাজি ইন্ডোরে মুর্শিদাবাদ থেকেই ১১০টা গাড়ি এনে যদি ভাবা হয় সব ঠিক চলছে, জবাবটা সময়ই দেবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy