বাঁ দিকে, সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার বিরোধিতায় ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ডান দিকে, রাজভবনের সামনে ধর্নায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ এবং পিটিআই।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার একটু পরে মঞ্চের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে গান ধরলেন দোলা সেন, ‘‘যত হামলা করো সব সামলে নেব...।’’ এক লহমায় রাজভবনের উত্তর ফটকের অনতিদূরের জনকোলাহলে গুঞ্জন উঠল। ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ শুরু হয়েছে।
মঞ্চের ভিড়ের মধ্যে একেবারে পিছনের সারিতে বসে আছেন এক মধ্য তিরিশের যুবক। তাঁকে ঘিরে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ-কাউন্সিলররা। দোহারা চেহারার যুবকের পরনে সাদা ফুলস্লিভস শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার্স। দু’পায়ে সাদা মোজা। মঞ্চে ওঠার আগে জুতো জোড়া ছেড়ে এসেছেন নীচে। গলায় ফেরতা দিয়ে পরা গাঢ় নীল উত্তরীয়। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। দোলার গানের সঙ্গে হাতে হাতে মৃদু তালি দিয়ে তাল মেলাচ্ছেন।
দেখতে দেখতে প্রায় দু’দশক আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ধর্মতলার মোড়ে মেট্রো সিনেমাহলের উল্টোদিকে (কলকাতা পুলিশের লগবুকে তদানীন্তন ‘মেট্রো চ্যানেল’) এমনই এক ধর্নামঞ্চ। সেখানে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অনশনে বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যতক্ষণ না জমি ফেরানো হবে, ততক্ষণ অনশন চলবে। ঠিক যেমন বৃহস্পতিবারের আরও এক ধর্নামঞ্চ থেকে তাঁর ‘উত্তরসূরি’ ঘোষণা করলেন, ‘‘যতক্ষণ না রাজ্যপালের সঙ্গে আমরা দেখা করতে পারব, ততক্ষণ আমি এই ধর্নামঞ্চ ছাড়ব না।’’
ধর্মতলার অনশন মঞ্চের আগে মমতা আগেও এমন বহু ধর্নায় অংশ নিয়েছেন। পরেও। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে এমন সিদ্ধান্ত এই প্রথম! গত মঙ্গলবার রাতে দিল্লিতে তাঁদের ‘হেনস্থা’র প্রতিবাদে সেই রাতেই অভিষেক ঘোষণা করেছিলেন, বৃহস্পতিবার ‘রাজভবন চলো’ কর্মসূচির কথা। ঠিক ছিল, মিছিল করে এসে রাজ্যপাল সিভি আনন্দবোসের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা স্মারকলিপি দেবেন ‘বাংলার গরিব মানুষের বকেয়া টাকা’ ফেরত দেওয়ার জন্য। যে দাবি তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। কিন্তু অভিষেক ছাড়ার পাত্র নন। রাজ্যপাল ‘কেন্দ্রের প্রতিনিধি’। তাই তিনি ঘোষণা করেন, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে ওই স্মারকলিপি দেবে তৃণমূল।
সেইমতোই বৃহস্পতিবার জনস্রোত নিয়ে ডালহৌসির রেড ক্রস প্লেসে রাজভবনের সামনে হাজির হন ‘তৃণমূলের সেনাপতি’। ততক্ষণে সেখানে মঞ্চ বাঁধা হয়ে গিয়েছে। তখন থেকেই খানিকটা আন্দাজ করা গিয়েছিল যে, অভিষেক রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসে পড়তে পারেন। কারণ, ততক্ষণে সকলে জেনে গিয়েছেন যে, রাজ্যপাল রাজভবনে নেই। তিনি দিল্লি থেকে উত্তরবঙ্গে এসে বন্যা পরিস্থিতি দেখে আবার দিল্লিতেই ফিরে গিয়েছেন। কবে ফিরবেন, তা খুব একটা নিশ্চিত নয়।
সম্ভবত তখন থেকেই গোটা বাংলার ‘ফ্ল্যাশব্যাকে’ ফিরে যাওয়া শুরু। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। যত সময় এগিয়েছে, ততই গোটা কর্মসূচিতে প্রকট হয়েছে ‘মমতা ছায়া’। তৃণমূল সূত্রের খবর, অসুস্থতার জন্য দলের সর্বময় নেত্রী নিজে কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি বটে। কিন্তু বাড়ি থেকে গোটা কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন। যে কারণে নবীন প্রজন্মের সঙ্গে প্রবীণেরাও পৌঁছেছেন ধর্না মঞ্চে। খবর আরও যে, অভিষেকের এই আন্দোলনে মমতা খুশি।
কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বকেয়া অর্থের দাবিতে গত মার্চ মাসে রেড রোডে দু'দিনের ধর্না কর্মসূচি নিয়েছিলেন মমতা। সেটিই তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর সাম্প্রতিকতম ধর্না। কাকতালীয় ভাবে, রেড ক্রস প্লেসে একই দাবিতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ধর্না-অবস্থান শুরু করলেন অভিষেক।
এবং ‘প্রথম’ শব্দটির মধ্যে সম্ভবত একটিু বাড়তি ব্যঞ্জনা যোগ করে গেলেন এক যুবতী। সঙ্গে কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই। আশেপাশে কোনও নেতা-নেত্রীর ভিড় নেই। রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় নিঃশব্দে এলেন এবং একটা সাদা এসইউভি-তে চড়ে প্রায় একাই ফিরে গেলেন। স্বাভাবিক। অভিষেক রাজনীতিক হলেও তাঁর স্ত্রী তো তা নন। কিন্তু এই প্রথম কলকাতা শহরের রাস্তায় ধর্নায় রাত কাটাবেন রুজিরার স্বামী। স্ত্রীকে তো এক বার সেখানে আসতেই হত।
মঞ্চে ততক্ষণে অভিষেককে ঘিরে নবীন এবং প্রবীণ প্রজন্মের ভিড়। বক্তাদের গলায় অভিষেকের নেতৃত্বে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা এবং সমর্থন। সেখান থেকেই ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ এবং ‘উত্তরাধিকার’-এর সঙ্কেত এল সাধারণ্যে। মমতার অবস্থান এবং ধর্নার মঞ্চে যা যা হত, অভিষেকের মঞ্চেও হুবহু তা-ই হচ্ছে। তফাত হল, মমতা ধর্নায় বসতেন রাজ্যে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে। অভিষেক বসেছেন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে। মমতার মঞ্চে সঞ্চালক থাকতেন সুব্রত বক্সী বা অন্য কোনও প্রথম সারির নেতা। অভিষেকের মঞ্চে প্রথম দিন সেই ভূমিকা পালন করেছেন বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়। তিনি একে একে বক্তৃতা করতে ডেকেছেন প্রবীণ নেতাদের। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম— যাঁরা ধর্মতলার মোড়, সিঙ্গুরের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, হাজরা মোড়, বেদী ভবনের মতো অজস্র অবস্থান মঞ্চে আন্দোলনরত মমতার সঙ্গী থেকেছেন। ছিলেন সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন, শতাব্দী রায়, বিধায়ক তাপস রায়, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো ‘পুরনো’রা। বৈশ্বানর ডাকলেন তাঁদেরও, যাঁরা পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। যাঁকে মঙ্গল রাতে কৃষিভবন থেকে চ্যাংদোলা করে বার করেছিল দিল্লি পুলিশের মহিলাবাহিনী। ডাকলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, প্রদীপ মজুমদার, শশী পাঁজা, সাংসদ প্রতিমা মণ্ডলদের। মঞ্চে তখন বসে আছেন অরূপ চক্রবর্তীর মতো প্রথম বারের কাউন্সিলরও।
রাজভবনের সামনে এমন ধর্না-অবস্থান, তা-ও রাজ্যের শাসকদলের, এমন দৃষ্টান্ত নিকট অতীতে এই রাজ্য দেখেছে বলে খুব একটা কেউই মনে করতে পারছেন না। রাজভবনের সামনে এই ধরনের রাজনৈতিক কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ ভিড়ও সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি। যে ভিড় সন্ধ্যার এক পশলা বৃষ্টিতেও তাদের জায়গা ছেড়ে নড়ল না। যে ভিড়ের মধ্যে প্রবল উচ্ছ্বাস দেখা গেল অভিষেক বক্তৃতা করতে ওঠার সময়।
‘তৃণমূলের সেনাপতি’ গলা চড়াননি। দীর্ঘ বক্তৃতাও করেননি। শুধু ঘোষণা করেছেন, রাজ্যপাল তাঁদের সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত তিনি ওই মঞ্চেই থাকবেন। নড়বেন না। তার আগে দলীয় সতীর্থদের হাতে যথাবিহিত স্মারকলিপি পাঠিয়েছেন রাজভবনে। আর জনতাকে বলেছেন, ‘‘বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ভাল না। আপনারা ঠিকমতো বাড়ি ফিরে যান। আমি এখানেই থাকব। যতক্ষণ না রাজ্যপাল আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন, ততক্ষণ বাংলার গরিব মানুষের জন্য আমাদের এই লড়াই চলবে।’’
চলে যাওয়া দূরস্থান, তৃণমূলের নবীন প্রজন্মের মেজ-সেজো নেতারা তখন ফোনে বলছেন, ‘‘যেখানে যে যে আছে, চলে আসতে বল! এবি (অভিষেকের নাম-পদবির আদ্যক্ষর মিলিয়ে তাঁকে দলের অন্দরে নিজেদের মধ্যে এই নামেই ডেকে থাকেন অনেকে) ধর্নায় বসে গিয়েছে!’’
মমতা প্রায়ই বলেন, ‘‘নেতা গাছে হয় না। আন্দোলনের গর্ভেই জন্ম হয় নেতার।’’ আর খানিকটা তৃপ্তির সঙ্গেই জানান, তিনি দলের দ্বিতীয় প্রজন্মকে তৈরি করে দিয়েছেন। মমতা নিজে আন্দোলনের ফসল। আন্দোলনের রাস্তাতেই মমতার রাজনৈতিক উত্থান। তাঁর জুতোয় পা গলালেন অভিষেক। যিনি এখন আগ্রাসী বিরোধী নেতার ভূমিকায়। দিল্লিতে যা শুরু হয়েছিল, তার রাশ তিনি ধরে রেখেছেন কলকাতায় ফিরেও।
বাংলার শাসক থাকাকালীন এমন উত্তরাধিকার বাম জমানাতেও দেখা যায়নি। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল সিপিএম। কিন্তু তা প্রশাসনিক স্তরে। অভিষেকের ক্ষেত্রে সেই উত্তরাধিকার এল রাস্তায় নেমে আন্দোলনের পথ ধরে।
একটা সময়ে তৃণমূলের প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ অভিষেককে ‘নেতা’ মানতে কুণ্ঠিত বোধ করছিলেন। বৃহস্পতিবার তাঁদের মধ্যেই অনেকে রেড ক্রস প্লেসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিষেককে ভূষিত করার বিশেষণ হাতড়াচ্ছিলেন। তবে সারসত্যটি বলে দিলেন বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী শোভনদেব, ‘‘আমাদের নেত্রী বলেন পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি। আজ অভিষেক সেটা প্রমাণ করে দিলেন।’’
মঞ্চে দোলার পরে গাইতে উঠে দোলাকে ডেকে নিলেন গায়ক-মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। দু’জনে গলা মিলিয়ে গাইলেন ‘আমরা করব জয়। উই শ্যাল ওভারকাম’। অতীতের ‘ফ্ল্যাশব্যাক’-এর সঙ্গে মিলে গেল ‘বর্তমান’। উত্তরাধিকারের ধর্না মঞ্চে মিলে গেল প্রবীণ এবং নবীন প্রজন্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy