Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

সূচ-সুতোয় স্বনির্ভরতার স্বপ্ন বোনেন সোনালিরা

পাশের বাড়ির মোরগটা ডাকার আগেই বিছানা ছাড়েন ওরা। তারপর এলোখোপা বেঁধে, কোমরে আঁচল গুঁজে উঠোন নিকিয়েই শুরু হয় রোজকার রাঁধাবাড়া, ঘর গুছোনো, ছেলে সামলানো...। ডেডলাইন দশটা। তারমধ্যেই দশহাতে সব কাজ সেরে কাঁধে ব্যাগটা ফেলে চটিপায়ে হাঁটতে শুরু করেন ওরা। সংসারের উনকোটি চৌষট্টি, তরকারিতে নুনটা ঠিন হল কি না, সে ভাবনা তখন আবছা। বরং আগের দিন শেখা নতুন নকশাটা কী ভাবে আরও নিপুণ করা যায় সেটাই মাথায় ঘুরছে।

ব্যস্ত হাতে নানা নকশা ফোটাচ্ছেন মহিলা সমিতির সদস্যেরা।

ব্যস্ত হাতে নানা নকশা ফোটাচ্ছেন মহিলা সমিতির সদস্যেরা।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০১:২৩
Share: Save:

পাশের বাড়ির মোরগটা ডাকার আগেই বিছানা ছাড়েন ওরা। তারপর এলোখোপা বেঁধে, কোমরে আঁচল গুঁজে উঠোন নিকিয়েই শুরু হয় রোজকার রাঁধাবাড়া, ঘর গুছোনো, ছেলে সামলানো...। ডেডলাইন দশটা।

তারমধ্যেই দশহাতে সব কাজ সেরে কাঁধে ব্যাগটা ফেলে চটিপায়ে হাঁটতে শুরু করেন ওরা। সংসারের উনকোটি চৌষট্টি, তরকারিতে নুনটা ঠিন হল কি না, সে ভাবনা তখন আবছা। বরং আগের দিন শেখা নতুন নকশাটা কী ভাবে আরও নিপুণ করা যায় সেটাই মাথায় ঘুরছে। তারমধ্যেই ওরা পৌঁছে যান ফিকে হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটার সামনে। দরজা দিয়ে ঢুকে সেলাই মেশিনে বসতেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মহিলাদের দুর্দশা, পরনির্ভরতার সঙ্গে অনবরত যুঝতে শেখাচ্ছে কাটোয়ার এই মহিলা সমিতি। নারীদের শিক্ষিত, স্বনির্ভর করে তোলার এই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীণা দাস ভৌমিক-সহ আরও কয়েকজন। তারপর বহু বসন্ত কেটে গিয়েছে। বহু কঠিন সময় পার হয়ে আজও নারীদের স্বনির্ভরতার পাঠ দেয় এই সমিতি। শেখায় নিজের উপর বিশ্বাস না হারাতে। এককথায়, কাটোয়া শহরের তিলি পাড়ার মহিলা সমিতির এই ভবন বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছে বহু নারীকে।

খাতায়-কলমে ১৯৫৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর গঠিত হয় এই সমিতি। ওই দিন বিকেল পাঁচটায় শহরের বিশিষ্ট লীলা নন্দীর বাড়িতে কমলা মুখোপাধ্যায়, কৌশল্যা প্যাটেল, আশালতা রায়, শ্বেতবরণ সিংহ, ঈশাণী দত্ত, মুক্তকেশি সিংহ, রাধারণী চন্দ্র-সহ কয়েকজনের উপস্থিতিতে পথ চলা শুরু হয়। সম্পাদিকা নির্বাচিত হন বীণা দাস ভৌমিক ও সভানেত্রী নির্বাচিত হন মায়া ঘোষ। কাটোয়া শহরের গৌরাঙ্গ পাড়ার বাসিন্দা ইতিহাস সন্ধিৎসু সমীর চট্টোরাজ বলেন, “বীণাদেবী কাটোয়া ডিডিসি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। সেই সময় শহরের বিশিষ্ট মহিলাদের সহযোগিতায় কাটোয়া মহিলা সমিতি গঠন করেছিলেন তিনি। দুঃস্থ মহিলাদের স্বনির্ভর করাই মূল লক্ষ্য ছিল।” ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্য বদলায়নি সমিতির। বরং এত বছর এত মেয়ের লড়াইয়ের গল্পে আরও দৃঢ় হয়েছে লক্ষ্য। সমিতির সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ থানা ভবনের সামনের বাড়ির মানু সাহার। তিনিও বলেন, “কমলা মুখোপাধ্যায়-সহ এই প্রতিষ্ঠান যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে নানা ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সেই উপলব্ধি থেকেই মহিলা সমিতি গঠনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল।” জানা যায়, প্রয়াত কমলাদেবীর স্বামী অনাদিবাবু মহিলা সমিতি গড়ার জন্য তিলি পাড়ায় ২ কাঠা জমি দান করেছিলেন। চাঁদা তুলে সেখানেই দোতলা ভবন তৈরি করেন সদস্যেরা।

প্রায় ৬০ বছর আগে এঁদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল পথ চলা।

সমিতির ৬২ জন সদস্যের একজন, কাটোয়া পুরসভার কাউন্সিলর কণিকা সিংহও। তিনি বলেন, “একসময় রমরমা ছিল আমাদের সমিতির। কলকাতার তিনটে সংস্থা নিয়মিত কাজের বরাত দিত। এখন অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও কোনওরকমে সমিতিটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।” জানা যায়, একসময় বিমান সেবিকাদের ব্যাগ, টুপি, অ্যাপ্রন, নামি কোম্পানির হোটেলের বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় সবই তৈরি করতেন এখানকার সদস্যেরা। কিন্তু নিয়মিত কলকাতার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজের বরাত আনবে এমন মহিলার সংখ্যা কমে যায়। কাজের বরাত কমায় ধুঁকতে শুরু করে সমিতিও।

একসময় সেলাই ছাড়াও বড়ি, আচার, সাবুর পাপড়, ছাতু এ সমস্ত তৈরি করে বিক্রি করা হতো এখানে। এখন অবশ্য নানা ধরনের সেলাইয়ের কাজই হয়। কাটোয়া শহর তো বটেই, আশপাশের দেয়াসিন, গঙ্গাটিকুরি, শ্রীখণ্ড, দাঁইহাট, নদিয়ার মাটিয়ারি থেকেও বহু মেয়ে-বউরা আসেন এখানে। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দুই শিফটে কাজ হয়। সমিতির এক জন স্নিগ্ধা সাহা বলেন, “আমাদের এখানে সেলাই শিখে স্বনির্ভর হয়েছেন এমন উদাহরণ বহু। পরে তাঁদের অনেকেই নিজের গ্রামে দোকানও খুলেছেন।” সেলাই শোখানোর পাশাপাশি এমব্রয়ডারির কাজ করেও উপার্জন করেন অনেক সদস্য। সেক্ষেত্রে সমিতির তহবিল থেকেই কাপড়, সুতো কিনে দেওয়া হয়। তাতে সুতোর কাজ করে ফেরত দেন কর্মী, সদস্যেরা। সেই কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করেন আরেক দল কর্মী। সমিতির সঙ্গে যুক্ত সাগরিকা বৈরাগ্য, সোনালি দাসেরা বলেন, “এখান থেকে আয় করে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর কাজে ব্যয় করি আমরা।” আরেক জন মানুদেবী বলেন, “আমাদের ব্যবসায়ী পরিবার। আচমকা টানাটানিতে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আয়ের পথ খুঁজে পাই। এখন আমার বৌমা ও মেয়ে এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত।” এঁদের দেখে উৎসাহিত হন এখনকার শিক্ষার্থীরাও। রুমকি সর্দার, অর্পিতা মণ্ডল, সুইটি খাতুন, জয়নাল বেগমরা বলেন, “এখানকার সেলাইয়ের কাজ দেশ-বিদেশে সমাদৃত। আয়ের পথ খুঁজতেই এখান থেকে কাজ শিখছি।” আয়ের পথ খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন নিজের উপর আস্থাও ফিরে পান এই মেয়েরা।

সূচ-সুতোয় ভর করে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে চলার সঙ্গেই সমাজসেবাও করেন মহিলা সমিতির সদস্যেরা। কর্মীদের মজুরি বাবদ পাঁচ শতাংশ টাকা ভাঁড়ে জমিয়ে রাখেন তাঁরা। জমানো টাকার সঙ্গে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে দুঃস্থদের শীতবস্ত্র কিনে দেওয়া কিংবা বন্যাত্রাণে সাহায্য করেন তাঁরা। দুঃস্থ মহিলাদের বিনামূল্যে সেলাই শেখানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে তাঁদের সরঞ্জামও কিনে দেয় সমিতি।

সংস্থার সভানেত্রী শিপ্রা ঘোষ বলেন, “ইচ্ছে তো অনেক, কিন্তু টাকার টানাটানিতে সবটা পূরণ করা যাচ্ছে না।” আর তাঁর দিকে চেয়ে থাকা চোখগুলো বলে, ইচ্ছেটাই তো সব। এ বাধাটাও নিশ্চয় কেটে যাবে।

প্রাত্যহিকের এই ইচ্ছেডানায় ভর করেই উড়ান দেন ওই নারীরা।

ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy