গ্যালারি ভেঙেছে কাটোয়া স্টেডিয়ামের। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
খেলাও নেই, দর্শকও নেই। ফিকে হয়েছে সবুজ ঘাসের সোনালি দিন।
অথচ একসময় কাটোয়ার বহু ফুটবল খেলোয়াড় কলকাতা তো বটেই, সারা বাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। টাউন অ্যাথলেটিক ক্লাব স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে আইএফএ শিল্ডও খেলেছে। কাটোয়ার মাঠেও খেলে গিয়েছেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদেশ বসু, সাত্তারের মতো বহু নামী ফুটবল খেলোয়াড়।
অথচ এখন শহর থেকে ফুটবলের সেই গরিমাটাই হারিয়ে গিয়েছে। কখন, কোথায়, ফুটবল খেলা হয়, কারা খেলে কেউ কোনও খোঁজ রাখে না। কাটোয়া মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সম্পাদক রণজিত্ চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “ভাবতে অবাক লাগে কাটোয়া শহর থেকে একটা ফুটবল দল গড়া যায় না, যেটুকু হয় জোর করে।” অথচ একসময় প্রতিযোগিতার দিন, তারিখ মুখস্থ থাকত দর্শকের।
শহরের টিএসি-র মাঠে দিনের পর দিন অনুশীলন করেছেন কাটোয়ার এক সময়ের বাসিন্দা, জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টর প্রদীপ চৌধুরী। শ্যামনগর, রিষড়া, রহড়ার মতো শহরতলি এলাকার বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলে গিয়েছেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, সাত্তার, নায়ার, সেলিম জামশেদ, মজিদ, সুব্রত ভট্টাচার্য, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, বিদেশ বসু, কৃশানু দে-সহ জাতীয় দলের একাধিক খেলোয়াড়। নয়ের দশকে গোড়াতেও টিএসি মাঠ কাঁপিয়েছেন চিমা-চিবুজোররা। স্মৃতিতে উঁকি মেরে আপনজন ক্লাবের সম্পাদক রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “১৯৭৪ সালের ঘটনা এখনও চোখে ভাসে। খেলা শেষে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত ভট্টাচার্য হাঁটু ভাঁজ করে বসে মাঠে চুমু খেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাংলার অনেক মাঠে খেলেছি, কিন্তু এ রকম মাঠ দেখিনি।’ খোলা মাঠে খেলে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মাঠটির উন্নতির জন্য সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তা নিতে পারিনি। সেই সময় জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।” আর এখন সেই মাঠে খেলা তো দূরের কথা, দিনে-রাতে অসামাজিক কাজকর্ম হয়। মাঠের চারিদিকের পাঁচিল ভেঙে গিয়েছে, টিকিট কাউন্টারও ভাঙা। গোলপোস্ট নেই। মূল দরজাটাও নেই। বিকেলে খেলতে এসে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে বলছিল, “গোটা মাঠ জুড়ে ভাঙা মদের বোতল। গরম যত বাড়বে মদের বোতলও বাড়তে থাকবে।”
কাটোয়া সিদ্ধেশ্বরী তলার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কাছ থেকে ১৯১৩ সালে মাঠটি পেয়েছিল টিএসি। মাঠটির পোশাকি নাম গোবিন্দ ফিল্ড। শতাধিক বছরের পুরনো এই মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। খোলা মাঠটিতে পাঁচিল দেওয়া হয় ১৯৫৫-৬০ সালে। ক্লাবের সদস্য, কাটোয়ার প্রাক্তন উপ-পুরপ্রধান, পঁচাশি বছরের গোলাম কিবরিয়া বলেন, “ওই মাঠটি কাটোয়ার ক্রীড়ামোদী মানুষের প্রাণ। স্টেডিয়াম করার জন্য কাটোয়া স্টেডিয়াম কমিটিকে মাঠটি হস্তান্তর করা হয়েছিল। বাম আমলের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্টেডিয়ামের শিলান্যাসও করেছিলেন। কিন্তু তারপরে আর কাজ এগোয়নি।” পরে কাটোয়া শহর লাগোয়া ২৪ একর জায়গায় স্টেডিয়াম গড়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালের ২৮ মে স্টেডিয়ামের উদ্বোধন হয়। বছর খানেক পর থেকেই অবশ্য হাল বদলাতে থাকে স্টেডিয়ামটির। একমাত্র গ্যালারিটি ভেঙে পড়ে। বর্তমানে স্টেডিয়ামের গ্যালারির গায়ে বড় বড় ফাটল। পলেস্তারা খসে লোহার রড বেরিয়েছে। উঁকি মারছে আগাছার জঙ্গল। এমনকী যে কোনও সময় গ্যালারি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও ক্রীড়াপ্রেমীদের আশঙ্কা। শহরের ক্রীড়াপ্রেমীদের অভিযোগ, বাম আমলে কয়েক’শো দর্শকের বসার জন্য একটাই গ্যালারি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের বছরপূর্তি হওয়ার আগে থেকেই গ্যালারির দশা খারাপ হতে থাকে। তারপর বহু বছর কেটে গেলেও স্টেডিয়াম সংস্কারের দিকে নজর নেই কারও। পাঁচিল থেকে প্রধান ফটক সবই ভাঙা। এমনকী নিকাশি ব্যবস্থা এতই খারাপ যে বছরের বেশিরভাগ সময় মাঠটি জলের তলায় থাকে। ক্রীড়াপ্রেমীদের দাবি, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বারবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও কোনও লাভ হয় নি।
জানা গিয়েছে, স্টেডিয়াম তৈরির পরে জেলাশাসকের তত্ত্বাবধানে একটি কমিটি তা দেখভালের কাজ করত। পরে জেলাশাসকের অনুমতিতে কাটোয়ার মহকুমাশাসকই স্টেডিয়াম ব্যবহারের অনুমতি দেন। গ্যালারির তলায় দুটি ঘরে মহকুমা পুলিশের ইমার্জেন্সি ফোর্স (ইএফ) রয়েছে। তাঁদের দাবি, প্রতি বর্ষাতেই ছাদ দিয়ে জল পড়ে আর কাটোয়া পুরসভা অস্থায়ী ভাবে তা সংস্কার করে। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সুভাষ চক্রবর্তী ক্রীড়ামন্ত্রী থাকাকালীন স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। পরেও বেশ কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়। তবে ওই স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকারের যুব ও ক্রীড়া দফতরে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও মহকুমা প্রশাসনের দাবি।
গোলাম কিবরিয়ার দাবি, আগে অনুশীলন করার জন্যও জায়গা পেতেন না খেলোয়াড়রা। এত খেলোয়াড়দের ভিড় থাকত টিএসি মাঠে। সেই সময় কাশীরাম দাস বিদ্যায়তনের মাঠ ছাড়াও ওই স্কুলের পিছনে, গঙ্গার ধারে দুটো, পানুহাটের কাছে চারা বাগানের একটি মাঠ ছিল। সেই সময় কলকাতার মাঠে দাপিয়ে খেলেছেন মৃত্যুঞ্জয় পাত্র (খিদিরপুর), কাল্লু খাঁ (কলকাতা পুলিশ) সহ অনেকে। পরবর্তী সময়ে অমর দে, অমর দাস, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, এনায়েত্ হোসেন, দিব্যেন্দু পাল, চন্দন চট্টোপাধ্যায়, বিদ্যুত্ চক্রবর্তীদের নাম উল্লেখযোগ্য। অমর দে বলছিলেন, “কাটোয়ার ছেলে শিশির দে গ্যাংটকে থাকাকালীন ভাইচুং ভুটিয়ার স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন।”
তবে এই মধ্যে আশার কথা শোনালেন কাটোয়ার বাসিন্দা, সাইয়ের (পূর্বাঞ্চল) প্রাক্তন মুখ্য কোচ হরিনারায়ণ দে। কাশীরাম দাস বিদ্যায়তনের মাঠে খুদেদের কোচিং করাতে করাতে তিনি বলেন, “খেলোয়াড়ও আছে। অভিভাবকদের মধ্যে উত্সাহও আছে। কিন্তু ভাল সংগঠক নেই। থাকলে কাটোয়ার চেহারাটাই বদলে যাবে।”
সত্যিই, সংগঠক থাকলে কী আর এ রাজ্যের অন্যতম পুরনো ফুটবল প্রতিযোগিতা হরিশচন্দ্র শিল্ড ও ইস্টপদ রানার্স কাপ বন্ধ হয়ে যায়!
কেমন লাগছে আমার শহর? আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বর্ধমান’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বর্ধমান বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy