ছোট নাটক উত্সবের একটি মুহূর্ত। ছবি:অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাসখানেক আগের কথা। কাটোয়া শহরের একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ সংহতি মঞ্চে চলছে পাঁচ দিনের নাট্যোত্সব। নাটক শেষে দর্শকেরা হাততালি দিয়ে অভিনেতাদের কুর্ণিশ জানাবেন কি, অভিনেতারাই ভূয়সী প্রশংসা করলেন দর্শকদের।
কাটোয়া শহরের সঙ্গে নাট্যচর্চার যোগাযোগ এমনই নিবিড়। যে দলই আসেন এ শহরে নাটক করতে, তাঁদের প্রত্যেকেই বারবার অভিনন্দন জানান দর্শকদের, তাঁদের ধৈর্য্য, নাটকের প্রতি আগ্রহ ও সংস্কৃতিমনস্ক মননকে। সম্প্রতি রহড়ার স্বপ্নালু প্রযোজিত ‘অতিথি’ নাটকের অভিনেতা, বাংলা সিনেমার অন্যতম পরিচিত মুখ শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “কাটোয়ার মতো এত ভাল নাটকের দর্শক খুব কম জায়গায় দেখতে পেয়েছি।” হালফিলের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট, সিনেমা, ফেসবুকের জগতে নাটকের মতো আবৃত্তিরও প্রচুর শ্রোতা রয়েছেন কাটোয়ায়। নানা অনুষ্ঠানে এসে তাঁদেরও প্রশংসা করে গিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা। তবে মাঝখানে প্রায় দেড় দশক নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিলই না এ শহরের। সম্প্রতি পালে হাওয়া লেগেছে ফের।
এ শহরে নাট্যচর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। নাট্য ব্যক্তিত্ব শিশির মুখোপাধ্যায় জানান, ১৮৯৭ সাল থেকে কাটোয়া শহরে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল। অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নাট্যচর্চা চালিয়ে গিয়েছেন এই শহরের পুরনোরা। নাট্যকার হিসাবে অনেকেই পরিচিতিও পান। কাটোয়ার সংস্কৃতি ও ইতিহাস বইয়ে প্রকাশিত রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৮৯৭ সালে শহরের বর্তমান তাঁতিপাড়ায় প্রথম নাটক হয়। গিরীশ ঘোষের লেখা নাটক ‘জনা’ মঞ্চস্থ প্রথম করেন স্থানীয় বাসিন্দা দেবেন্দ্র বিজয় দাস, হরধর অধিকারীরা। ১৯০৩ সালে ওই তাঁতি পাড়াতেই মঞ্চস্থ হয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘দুর্গাদাস’। অনেকেই এক বাক্যে স্বীকার করে নেন, কাটোয়া শহরের নাটকের ইতিহাসে আদর্শ ক্লাবের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ওই ক্লাবের ক্ষিতীশ দাস, নিরঞ্জন মল্লিক, বলরাম ঠাকুর, রাধারমণ দে, বটদাস মহান্তরা তিলিপাড়া-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চ বেধে নাটক করতেন। তবে পরবর্তীতে ওই ক্লাব ভেঙে ১৯৩৬ সালে গঠন হয় ‘কাটোয়া নাট্য বয়েজ ক্লাব’। ওই সময়েই তাঁতিপাড়ায় গড়ে ওঠে ‘রমণীমোহন নাট্য সমিতি’, ‘ডিবেটিং’ ক্লাব। ১৯৩৯ সালে ধর্মদাস মল্লিকের উদ্যোগে কাটোয়ার সমস্ত শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চস্থ হয় ‘টিপু সুলতান’। রঞ্জিতবাবু লিখছেন, ‘সম্ভবত এটিই কাটোয়ার প্রথম কম্বিনেশন শো’। কাটোয়া রবীন্দ্র পরিষদের সম্পাদক তুষার পণ্ডিত বলেন, “শহরে নাট্যচর্চা বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল বলেই ১৯১৭ সালে কাটোয়াতে টাউন হল তৈরি হয়েছিল। সেখানে দর্শক সঙ্কুলান হতো না বলে এখনকার এসডিপিও দফতরের কাছে বাদলবাবুদের জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ হতো।” তিনি জানান, টাউন হল গড়তে জায়গা দিয়েছিলেন অন্নদাপ্রসাদ সাহা চৌধুরী। এই টাউন হল গড়ার জন্য শহরবাসীর কাছ থেকেও চাঁদা তোলা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছিলেন অগ্রদ্বীপের জমিদার রমাপ্রসাদ মল্লিক। তাঁর নামেই টাউন হলের নামকরণ হয়। পরে ওই টাউন হলের পাশে তত্কালীন মহকুমাশাসক জ্যোতিন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে জেএম ক্লাব গড়ে ওঠে। ওই ক্লাবের সদস্যেরাও কাটোয়া শহরের বেশ নিয়মিত নাট্যচর্চা করতেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একে একে বহু সংস্থা, ক্লাবই গড়ে ওঠে এ শহরে। তাদের মধ্যে ছিল অগ্রগামী তরণ সঙ্ঘ, আইডিয়াল অ্যাথেলেটিক ক্লাব। পঞ্চাশের দশকে মালোপাড়ায় জন্ম নেয় উদয়ন সঙ্ঘ, দক্ষিণ কাটোয়া নাট্যসংস্থা। তাঁরা ‘সিরাজের স্বপ্ন’, ‘মিশরকুমারী’, ‘প্রফুল্ল’-সহ একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করে। এর মধ্যেই টাউন হলের পাশে ১৯৫৯ সালে তৈরি হয় ‘মহিমারঞ্জন রঙ্গমঞ্চ’। নতুন মঞ্চ পেয়ে কাটোয়াতে নাট্যচর্চা আরও বেড়ে যায়। এই মঞ্চেই হয় রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। বিশিষ্ট সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন। ওই সময় শুধুমাত্র মহিলা শিল্পীদের নিয়ে অধ্যাপক সুনীল চক্রবর্তী লেখা ও পরিচালিত ‘অবগুন্ঠন’ নামে একটি নাটক হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ওই মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় মিলন সঙ্ঘের চারটি নাটক। ১৯৬৫ সালে ওই মঞ্চেই পাঁচদিন ধরে চলে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা। সাতের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্তও একের পর এক সফল নাটক প্রযোজিত হয়েছে। কাটোয়া শহরের এক নাট্যকর্মী বুদ্ধদেব মণ্ডল বলেন, “নয়ের দশকে আমাদের হাতে জন্ম নেয় উড়নচণ্ডী। আমরা গোটা দক্ষিণবঙ্গ ও মালদা জেলা নিয়ে ৫২টি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। বিভিন্ন নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পেয়েছি।” আরও পরে ১৯৭৮ সালে টাউন হল পুনর্গঠনের দাবিতে কাটোয়া মহকুমা সংস্কৃতি পরিষদ গড়ে ওঠে। মিছিল করে টাউন হল ভাঙেন সংস্কৃত পরিষদের কর্মীরা। সেই জায়গায় তৈরি হয় আজকের ‘সংহতি মঞ্চ’। তার আগে ১৯৬৬ সালে তৈরি হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র-সংস্কৃত চর্চার জন্য রবীন্দ্র পরিষদ।
তবে এরপরে প্রায় দেড় দশকের একটা ফাঁক রয়েছে। শহরের নাট্যকর্মীরা জানান, নয়ের দশক শুরুর পর থেকে প্রায় দেড় দশক কাটোয়া শহরে নাটকের কোনও ধারাবাহিকতা ছিল না। নাটক যে একেবারে মঞ্চস্থ হত না তা নয়, তবে তা হয়তো বছরে একটা। নাটকের মানের ক্ষেত্রেও একটা বড় পতন দেখা গিয়েছিল। তারপরে বহুবচন নামে একটি সংস্থার হাত ধরে কাটোয়া শহরে আবৃত্তি ও কবিতা পাঠের কদর ফের বাড়তে শুরু করে। প্রতি বছর কলকাতার বিশিষ্ট কবি থেকে নামী বাচিক শিল্পীরা কাটোয়াতে এসে অনুষ্ঠান করেন। শুধু তাই নয়, কয়েক সপ্তাহ আগে ‘বহুবচন’ সংস্থার কর্ণধার নন্দন সিংহ একক অনুষ্ঠানও করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, “ওই অনুষ্ঠানে মাইকেল মধূসূদন থেকে সমকালীন কবিদের কবিতা আবৃত্তি করা হয়। হল ভর্তি দর্শক বুঁদ হয়ে কবিতা শোনেন। এর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়েরাও কাটোয়ার দর্শকদের একই ভাবে প্রশংসা করে গিয়েছেন। সেই দিন আমারও একই অভিজ্ঞতা হল।”
এখন আবারও জোয়ার এসেছে নাটকে। প্রতি বছর কৃষ্টি, জাগরী, রবীন্দ্র পরিষদ ও অনুভব নামে চারটে সংস্থা নাট্যোত্সব করে। তার মধ্যে রবীন্দ্র পরিষদ ও অনুভব শুধু কাটোয়ার নাট্যসংস্থাগুলিকে নিয়ে উত্সব করে। এদের দাবি, পুরসভা পরিচালিত সংহতি মঞ্চটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে ভাল হয়। পুরসভাও হলটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করার আশ্বাস দিয়েছে।
নাট্যচর্চার এই প্রবাহে নিরন্তর গতি রাখাটাই চ্যালেঞ্জ নতুনদের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy