জলের সঙ্গে ছোলা, গুড়, বাতাসা দিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ্মী মণ্ডল নিজস্ব চিত্র।
এক জন আশি পেরিয়েছেন। অন্য জন ষাট। বর্ধমান-বোলপুর ২বি জাতীয় সড়কের পাশে, পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের শিবদা এলাকায় এক কিলোমিটারের ব্যবধানে দেখা যায় তাঁদের। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত পথিকের হাতে জল-মিষ্টি তুলে দেন তাঁরা।
বাস টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির একচালা ঘরে। ভাতারের মাহাতা পঞ্চায়েতের ঝর্না কলোনির বাসিন্দা লক্ষ্মী মণ্ডলকে রোজ দেখা যায় দিঘির পাড় এলাকায়, বর্ধমান-বোলপুর ২-বি জাতীয় সড়কের পাশে। টেবিলের উপরে জল ভর্তি মাটির কলসি, ছোলা, বাতাসা নিয়ে গাছের তলায় বসেন ষাটোর্ধ্ব লক্ষ্মী।
আশি পেরনো বিশাখা রায়ের দেখা মেলে আউশগ্রামের শিবদা এলাকায় ওই সড়কের পাশে। লাল শালুতে জড়ালো ঠান্ডা জলের কলসি, ছোলা, গুড় থাকে তাঁর কাছে। গত ১৫ বছর ধরে বৈশাখ মাস জুড়ে এ ভাবেই পথিকদের তৃষ্ণা নিবারণ করে আসছেন তিনি।
লক্ষ্মী বলেন, “এক সময় খুব কষ্ট পেয়েছি। ২২ বছর আগে, স্বামী মারা যান। তখন আমার কোলে দুই ছেলে। জলকষ্টে ভুগেছি এক সময়। এখন অবস্থা কিছুটা ফিরেছে। ছেলেরা রোজগার করছে। মাস দু’য়েক হল বিধবা ভাতা পাচ্ছি। সে টাকা দিয়ে ছোলা, বাতাসা কিনি। পথচারীদের ঠান্ডা জল ও ছোলা খাওয়াই। রোজ কেজি খানেক ছোলা আর কেজি দু’য়েক বাতাসা লাগে। স্নান সেরে, রাস্তার ধারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে সকলকে জল দিই। কলসির জল ফুরালে দুই বৌমা জল দিয়ে যায়।”
অনেকে ভাবেন জলের বিনিময়ে পয়সা দিতে হবে। তাঁদের সে ভুল ভাঙাতে নিজেই এগিয়ে গিয়ে পথিকদের হাতে জলের গ্লাস তুলে দেন। লক্ষ্মীর কথায়, “ঘামে ভেজা মানুষজনকে জল খেয়ে তৃপ্তি পেতে দেখে আমার আনন্দ হয়।”
মাস কয়েক আগে আশি পেরিয়েছেন বিশাখা। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। পরে, এসে ওঠেন মেমারির পাল্লা রোডের ক্যাম্পে। তিনি বলেন, “প্রায় ১৫ বছর ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্ত পথচারীদের ছোলা-মিষ্টি-ঠান্ডা জল খাওয়াচ্ছি। প্রথম দিকে, সমস্যা হত। অনেকে বুঝতে পারতেন না। ডেকে-ডেকে জল দিয়েছি। এখন ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা অনেকেই আমাকে চিনে গিয়েছেন। এতে আমি মানসিক শান্তি আর তৃপ্তি পাই।”
বিশাখার ছেলে তুষারের কাঠ চেরাইয়ের কল। তিনিও ওই কাজে মাকে সাহায্য করেন। বিশাখা বলেন, “ছেলেমেয়েদের বহু কষ্টে দাঁড় করিয়েছি। এখন ছেলেই ছোলা, গুড়, মিষ্টির ব্যবস্থা করে দেয়। বৈশাখ মাসে প্রায় এক বস্তা ছোলা, দু’টিন গুড় লাগে।”
ঝর্না কলোনি এলাকার বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ বরাল বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে অনেক মানুষ যাতায়াত করেন। অনেকেই দুই বৃদ্ধার কাছে জল খান। খুব ভাল কাজ করছেন ওঁরা। ওঁদের পড়শি হয়ে গর্ব হয় আমাদের।”
গণেশ রায়, ইসমাইল শেখ, রতন চক্রবর্তীর মতো অনেকেই ওই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করেন। তাঁদের কথায়, “দুই বৃদ্ধা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বৈশাখ মাস জুড়ে মিষ্টি-জল দেন। গাড়ি নিয়ে গেলে, ওঁদের দেওয়া জল খাই। খুব আন্তরিক ভাবেই ওঁরা এই কাজ করেন।”
দুই বৃদ্ধার এই কাজকে কুর্নিশ জানিয়েছেন আউশগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক অভেদানন্দ থান্দার ও ভাতারের বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারী। তাঁরা বলছেন, ‘‘ওঁরাই প্রকৃত শিক্ষক। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থাকলে সামান্য আয়েও অনেক কিছু করা যায়। ওই দুই বৃদ্ধা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন, তা সকলকে অনুপ্রাণিত করবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy