Advertisement
০৬ অক্টোবর ২০২৪

ধর্মঘট তুলতে মারমুখী তৃণমূল, সঙ্গী পুলিশ

ইঙ্গিত মিলেছিল আগেই। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে অশান্তির আশঙ্কা সত্যি হল খনি-শিল্পাঞ্চলে। ধর্মঘটের সমর্থকদের উপরে হামলা, মারধরের অভিযোগ উঠল শাসকদলের লোকজনের বিরুদ্ধে। সঙ্গে যোগ হল পুলিশের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তার অভিযোগ। বার্নপুর থেকে জামুড়িয়া, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গোলমাল পাকল নানা এলাকায়। ধর্মঘট সফল করতে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা নেমে পড়লেন সকাল থেকে। দুর্গাপুরে ট্রেন আটকানোর চেষ্টা হয়।

আসানসোলের রাস্তায় মোটরবাইক বাহিনী। —নিজস্ব চিত্র।

আসানসোলের রাস্তায় মোটরবাইক বাহিনী। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০২:৪০
Share: Save:

ইঙ্গিত মিলেছিল আগেই। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে অশান্তির আশঙ্কা সত্যি হল খনি-শিল্পাঞ্চলে। ধর্মঘটের সমর্থকদের উপরে হামলা, মারধরের অভিযোগ উঠল শাসকদলের লোকজনের বিরুদ্ধে। সঙ্গে যোগ হল পুলিশের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তার অভিযোগ।

বার্নপুর থেকে জামুড়িয়া, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গোলমাল পাকল নানা এলাকায়। ধর্মঘট সফল করতে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা নেমে পড়লেন সকাল থেকে। দুর্গাপুরে ট্রেন আটকানোর চেষ্টা হয়। রাস্তায় নামলেন বিজেপি-র লোকজনও। তবে তুলনামূলক ভাবে তাদের তৎপরতা চোখে পড়ল কম। এলাকা দাপাল তৃণমূলের মোটরবাইক বাহিনী। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের কর্তারা অবশ্য অতি সক্রিয়তা বা কোথাও কাউকে মারধরের কথা মানতে চাননি।

এ দিন সকাল ৭টা নাগাদ আসানসোলে কালিপাহাড়ির কাছে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে সিপিএম। ঘণ্টাখানেক চলার পরে কয়েক জন তৃণমূল কর্মী সেখানে গেলে বচসা বাধে। এর পরেই অবরোধ তুলতে তৎপর হয় পুলিশ। পুরুষ-মহিলা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হয়। সিপিএমের আসানসোল জোনাল সম্পাদক মনোজ দাস-সহ অনেক সিপিএম কর্মীকে আটক করা হয়। এর খানিক পরে আসানসোল বাসস্ট্যান্ড থেকে সিপিএমের একটি মিছিল বাজারের দিকে যাচ্ছিল। সিপিএমের অভিযোগ, বড় ডাকঘরের কাছে আসানসোল দক্ষিণ থানার পুলিশ সেই মিছিলটির উপরে চড়াও হয়ে লাঠি চালায়। শুধু তাই নয়, তৃণমূল নেতা রাজু অহলুওয়ালিয়ার নেতৃত্বে একটি বাহিনীও হামলা চালায়। পুলিশ সিপিএম কর্মীদের টেনে-হিঁচড়ে ভ্যানে তোলে। বাদ যাননি প্রবীণ কর্মীরাও। রাজুবাবুর যদিও দাবি, ‘‘আমি কোথাও কোনও হামলা করিনি। বলপ্রয়োগ করে ধর্মঘট পালন করানোর চেষ্টা হচ্ছে দেখলে প্রতিবাদ করেছি।’’

সকাল ১০টা থেকে বড় গোলমাল শুরু হয় জামুড়িয়ায়। সেই সময়ে বোগড়া চটি মোড়ে খানিকটা দূরত্বের মধ্যে সিপিএম এবং বিজেপি কর্মীরা ধর্মঘটের সমর্থনে জাতীয় সড়ক অবরোধ করছিলেন। এসিপি (সেন্ট্রাল) শৌভনিক মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুলিশের বাহিনী গিয়ে তা তুলে দেয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, সিপিএমের কর্মীরা সেখান থেকে দলের স্থানীয় একটি অফিসে গিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ তৃণমূলের লোকজন পৌঁছে গোলমাল পাকায় বলে অভিযোগ। পুলিশের কাছে ওই তৃণমূল কর্মীরা দাবি করেন, জাতীয় সড়ক অবরোধকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। এর পরেই পুলিশ সিপিএম নেতা মনোজ দত্ত ও সুজিত দত্তকে ধরে নিয়ে যায়।

নেতাদের ছাড়াতে সিপিএমের কর্মীরা চারটি গাড়িতে করে থানায় যান। সিপিএম নেতা তাপস কবী অভিযোগ করেন, পুলিশ আলোচনার জন্য তাঁদের ভিতরে ডেকে পাঠিয়ে গ্রেফতার করে। এর পরেই বাইরে দলের জামুড়িয়া ১ ব্লক সভাপতি পূর্ণশশী রায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের লোকজন সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। ভাঙচুর করা হয় গাড়িগুলি। এসিপি-র নেতৃত্বে পুলিশ সিপিএম এবং তৃণমূল কর্মীদের তাড়া করে। লাঠিও চালানো হয় বলে অভিযোগ। মাঝে পড়ে আহত হন সংবাদমাধ্যমের দুই প্রতিনিধি। সিটুর জেলা সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরীর ক্ষোভ, ‘‘সারা রাজ্যে যে ভাবে পুলিশের লাঠি নিয়ে তৃণমূল মারধর করছে, এখানেও তাই হল। তবে এ ভাবে ওরা আমাদের আটকাতে পারবে না।’’ তৃণমূল নেতা পূর্ণশশীবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘সব শান্তিপূর্ণ ছিল। সিপিএম অস্তিত্ব জাহির করার জন্য ঝামেলা পাকিয়েছে।’’ মনোজবাবুদের বিকেলে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এরই মধ্যে আবার জামুড়িয়া বাজারে দলের মণ্ডল সভাপতি সন্তোষ সিংহ-সহ বিজেপি-র কিছু কর্মীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। পুলিশ সন্তোষবাবুকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাদের এক কর্মীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর বাড়ি যাচ্ছিলাম। তৃণমূল রাস্তায় হামলা চালায়।’’ বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা অলোক দাসের অনুগামীরা এই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ। তৃণমূল নেতা পূর্ণশশীবাবু বলেন, ‘‘এই ঘটনার সঙ্গে আদৌ আমাদের কেউ জড়িত কি না, খতিয়ে দেখা হোক।’’ অলোকবাবু অবশ্য কোনও হামলার কথা মানেননি। এসিপি (সেন্ট্রাল) শৌভনিকবাবু কোথাও লাঠি চালানোর কথা মানতে চাননি। তিনি জানান, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে।

আসানসোলে মুর্গাশোলের কাছে এ দিন সকালে ধর্মঘটের সমর্থনে জনা কয়েক বিজেপি সমর্থক পিকেটিং করছিলেন। দলের জেলা সম্পাদক প্রশান্ত চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, আচমকা তৃণমূলের লোকেরা তাঁদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নেতৃত্বে সেই রাজু অহলুওয়ালিয়া। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই মারধর হয়। তা ঠেকানোর বদলে পুলিশ বিজেপি কর্মীদেরই মারতে মারতে জিপে তোলে। বার্নপুর বাসস্ট্যান্ডে পিকেটিং করছিলেন সিপিএমের কর্মীরা। দলের নেতা পার্থ সেনগুপ্ত অভিযোগ করেন, এক দল তৃণমূল সমর্থক পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে মারধর শুরু করে। তাঁদের বেশ কয়েক জনকে আটক করা হয়। দুপুর ১২টা নাগাদ বার্নপুর স্টেশন রোডে তৃণমূলের এক মহিলা নেত্রী দলবল নিয়ে বিজেপি সমর্থকদের উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। দু’জনের মাথা ফেটে যায়। দুপুরে বরাকরে বিজেপি-তৃণমূলের বচসা বাধে। তবে পুলিশ চলে আসায় ঝামেলা বাড়েনি।

এ দিন দুর্গাপুরে রেল অবরোধের চেষ্টা করেন সিপিএম কর্মীরা। পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়। তাই কোনও ট্রেন আটকে ছিল না। ২ নম্বর জাতীয় সড়কের মুচিপাড়া মোড়ে মিছিল করে অবরোধের চেষ্টা করেন সিপিএমের লোকজন। দলের দুর্গাপুর ২ পূর্ব জোনাল সম্পাদক পঙ্কজ রায়সরকার-সহ প্রায় আড়াইশো জনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পঙ্কজবাবুর দাবি, ‘‘সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করে বাইরে বেরোননি। ধর্মঘট সম্পূর্ণ সফল।’’ শহরের সিটিসেন্টারে বন্ধ থাকা কিছু দোকান তৃণমূল জোর করে খোলানোর চেষ্টা করে বলে অভিযোগ সিপিএমের। তৃণমূল যদিও তা মানেনি। দলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) কার্যকরি সভাপতি সভাপতি ভি শিবদাসনের বক্তব্য, ‘‘দু’একটি ছোটখাট গোলমাল ছাড়া কোনও অশান্তি হয়নি। ধর্মঘট বিফল হয়েছে।’’ জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, ‘‘কোথাও কোনও অপ্রিয় ঘটনা ঘটেনি।’’

গত বছর লোকসভা ভোটে আসানসোলে বিপুল ভোটে জিতেছিল বিজেপি। সিপিএম পেয়েছিল তৃতীয় স্থান। শিল্পাঞ্চলের চার পুরসভায় ভোট আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে এ দিন ধর্মঘট সফল করতে পথে সিপিএমের উপস্থিতিই বেশি নজরে এসেছে। যদিও বিজেপি নেতারা তা মানতে নারাজ। দলের আসানসোল জেলা সাধারণ সম্পাদক বিবেকানন্দ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘সিপিএম হয়তো আসানসোল শহরে বেশি সক্রিয় ছিল। তবে কুলটি, বারাবনি, বার্নপুর, বরাকরে আমরাই বেশি নেমেছি। আমাদের কম তৎপরতার কথা ঠিক নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE