Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

বিয়ে রুখে জীবনের লড়াইয়ে জয়ী ওঁরা

অনলাইনে ৮২ শতাংশ নম্বর দেখে কান্না ধরে রাখতে পারেননি বর্ধমান ২ ব্লকের হাটশিমুল গ্রামের পিয়ালি মাল। জামুড়িয়ার বাগডিহা সিদ্ধপুর গ্রামের সোনালী মণ্ডলেরও বাবাও  মেয়ের ৬৮ শতাংশ নম্বর দেখে বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি!’’ 

বাঁ দিক থেকে, পিয়ালি ও সোনালী। নিজস্ব চিত্র

বাঁ দিক থেকে, পিয়ালি ও সোনালী। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত ও নীলোৎপল রায়চৌধুরী
বর্ধমান ও জামুড়িয়া শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২০ ০৪:৩১
Share: Save:

মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। কিন্তু অভাব, বাড়ির চাপেও মাথা নোয়াননি দুই কন্যা। নিজেরাই স্কুলে যোগাযোগ করে বিয়ে রোখেন। পড়াশোনা চালিয়ে যান প্রতিকূলতা নিয়ে। তাঁদের জেদ, পরিশ্রমের মান রেখেছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল।

অনলাইনে ৮২ শতাংশ নম্বর দেখে কান্না ধরে রাখতে পারেননি বর্ধমান ২ ব্লকের হাটশিমুল গ্রামের পিয়ালি মাল। জামুড়িয়ার বাগডিহা সিদ্ধপুর গ্রামের সোনালী মণ্ডলেরও বাবাও মেয়ের ৬৮ শতাংশ নম্বর দেখে বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি!’’

হুগলির পাণ্ডুয়ার কাছে ভুষালি গ্রামে পিয়ালির বাবা-মা থাকেন। অভাবের সংসারে দেড় বছর বয়স থেকেই হাটশিমুলে মামারবাড়িতে থাকেন পিয়ালি। ওই তরুণী জানান, ২০১৩ সালে মামা মারা যান। তারপর থেকে মাসি রাসমণি মালিক আগলে রেখেছেন তাঁকে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় পুতুল তৈরি কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চোখে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন।

তবে লড়াইটা এটুকুই নয়। মাধ্যমিক পাশ করার পরে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক হয় পিয়ালির। কিন্তু স্কুলের ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’-এর দলনেত্রী বিদ্রোহ করেন। শিক্ষকদের কাছে সব খুলে বলেন তিনি। প্রশাসন, ‘চাইল্ডলাইন’ বিয়ে রুখে দেয়। কিন্তু গ্রামের অনেকেই একরত্তি মেয়ের ‘সাহস’ মেনে নিতে পারেনি। পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি, দাবি ওই তরুণীর।

পিয়ালির মা স্বপ্না মাল বলেন, “আমরা ভুল করেছিলাম। এখন আর তা মনে রাখতে চাই না। শুধু চাই, পড়াশোনা করে ও এগিয়ে যাক।’’ পিয়ালিও বলেন, ‘‘বিয়ে রোখার পরে চাইল্ডলাইনের তরফে একের পরে এক কাউন্সেলিং হয়েছে। ওই সময়টা কাটিয়ে উঠেছি, এটাই বড় কথা।’’ মাসি রাসমণিদেবীর কথায়, ‘‘আমি চাই, ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আরও পাঁচটা মেয়ের দায়িত্ব নিক।’’

শ্রীরামপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, “ওদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই মিলে পড়ার খরচ দিয়েছি। পিয়ালি ভাল করবে কথা দিয়েছিল। কথা রেখেছে।’’ ‘চাইল্ডলাইন’-এর বর্ধমানের কর্ণধার অভিজিৎ চৌবে বলেন, “পিয়ালি উদাহরণ হয়ে থাকল।’’

সোনালীর যুদ্ধটাও একই রকম। ২০১৭ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের আগের দিন স্কুলে গিয়ে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে সটান বাগডিহা সিদ্ধপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শান্তনু ভট্টাচার্যের কাছে হাজির হন তিনি। যে কোনও উপায়ে বিয়ে আটকানোর আর্জি জানান। ছাত্রীর পড়ার ইচ্ছে দেখে ব্যবস্থা নেন ওই শিক্ষক। বিয়ের দিন দুপুরে মেয়ের বাড়িতে হাজির হয়ে বিয়ে আটকান প্রশাসনের কর্তারা।

সোনালীর মা গীতা মণ্ডল ওই স্কুলেই মিড-ডে মিল রান্না করেন। তাঁর কথায়, ‘‘অভাবের সংসার। বয়স্ক পাত্রের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম। তবে ও রাজি ছিল না। এখন মনে হয়, যা হয়েছে ভালই হয়েছে।’’ পেশায় দিনমজুর বাবা মুক্তি মণ্ডলও বলেন, ‘‘বড় মেয়েরও কম বয়সে বিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের পরে মারা যায় সে। এখন মনে হচ্ছে, সোনালীর বিয়ে না দিয়ে ভালই করেছি।” তবে পড়ার খরচ কী ভাবে জোগাবেন, জানা নেই তাঁর। ওই তরুণী বলেন, ‘‘উচ্চমাধ্যমিকের বই, খাতা, স্কুলের ‘ফি’ সব দিয়েছেন শান্তনুবাবু। জানি না, এর পরে কী হবে! তবে হাল ছাড়ব না।’’ শান্তনুবাবুর আশ্বাস, ‘‘যথাসাধ্য চেষ্টা করব। শুধু বলেছি, লেখাপড়াটা ছাড়িস না।’’

চিঁচুড়িয়া উপেন্দ্রনাথ বিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন সোনালী। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সব অভাবী ছাত্রীদের কাছে সোনালী উদাহরণ।’’

অন্য বিষয়গুলি:

HS exam 2020 marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy