সুতপা দেবনাথ। নিজস্ব চিত্র
তাঁরা আঁধারে আলো। করোনা-কালে দুর্গা আবাহনের পর্বে স্বপ্রভায় দীপ্ত মৃন্ময়ীদের সঙ্গে পরিচয়।
দিনের আলো ফুটলেই বিছানা ছাড়েন তিনি। ঘড়ির সঙ্গে দৌড়ে চলে ঘরের কাজ। ৯টা বাজলেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেল ছোটান। ঘর, পরিজন থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে বৃহত্তর সংসার সামলাতে চলেন নীল শাড়ির ‘আশা-দিদি’। বেলা বাড়ে, দুপুর, বিকেল গড়ায়। সন্ধ্যায় ফিরে দু’দণ্ড জিরনো। তবে মোবাইল বাজলেই ফের ছুট। তা সে যত দূরই হোক, যত
রাতই হোক।
১১ বছর ধরে আশাকর্মী হিসাবে কাজ করছেন পূর্বস্থলীর মধ্য শ্রীরামপুরের পাবনাপাড়ার সুতপা দেবনাথ। করোনা-কালে মা ও শিশুদের যত্ন নেওয়ার চেয়ে তাঁদের কাজের পরিধি বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। কোন বাড়িতে কার জ্বর, সর্দির উপসর্গ রয়েছে, বাইরে থেকে কোন বাড়িতে কে এসেছে, এলে ট্রেন, বাস না বিমানে এসেছেন, তাঁরা সুস্থ আছেন কি না, নিভৃতবাসে থাকতে হলে কোথায় রাখা হবে— সব দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে তাঁকে। আবার নিভৃতবাসে থাকাকালীন জল, আলোর অসুবিধা হলেও ফোন আসত ‘আশা-দিদি’র কাছেই। কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই সমস্যাও মেটাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর সকাল-রাতের ছুটোছুটির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন বাড়ির লোকেরাও। এখন সংক্রমণ কম থাকায় ছুটোছুটি একটু কম। তবে এলাকার স্বাস্থ্যের খবর রাখেন তিনিই।
সুতপাদেবী বলেন, ‘‘সারাদিন পরিশ্রম করে ফেরার পরে মাঝরাতে ফোন এলে বাড়ির লোকেরা বলত, ‘আর যেতে হবে না’। কিন্তু মানুষের ডাক, প্রয়োজনটা তো ফেলতে পারি না। আবার করোনা রোগীদের সংস্পর্শে আসছি বলে আমার থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় করতেন চেনা লোকেরা। নানা কথাও বলতেন। খারাপ লাগত। তবে মন ভাঙতে দিইনি।’’ তবে তাঁর থেকেও তাঁর সহকর্মীদের অনেককে আরও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, জানান তিনি।
কাজ করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও। সুতপাদেবীর কথায়, ‘‘এক বার ভিন্-রাজ্য থেকে এক যুবক ফিরেছেন শুনেই তাঁর বাড়িতে হাজির হই। তাঁকে নিভৃতবাসে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁর ব্যাগ নিয়ে বাড়ি চলে যান পরিজনেরা। ব্যাগ থেকে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কায় হুলস্থুল বাধে পাড়ায়। রাতে খবর পেয়ে গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি সামলাই।’’ আবার স্বাস্থ্য দফতরের গাড়ি না আসা পর্যন্ত রোগীকে পাহারা দিতেও তাঁর বাড়ির সামনে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, এমন দিনও কাটিয়েছেন তিনি।
সুতপাদেবীর স্বামী বাবলু দেবনাথ বলেন, ‘‘স্ত্রীকে নিয়ে খুব চিন্তা হত। ওর শরীর খারাপ হয়ে গেলে কী করব, ভেবেই ভয় লাগত। মেয়েরা, আত্মীয়েরা ফোন করে রোজ খবর নিত। বলতাম, ‘নিজের কথা ভেবে কাজ কোরো’। কিন্তু ও বলত, ‘এটা নিজের কথা ভাবার, নিজের জন্য বাঁচার সময় নয়’। এখন গর্ব হয় আমাদের।’’ পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিকও বলেন, ‘‘মানুষ যখন বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছিলেন, তখন আশাকর্মীরা মানুষকে আস্থা জুগিয়েছেন। বাড়ি-বাড়ি পরিষেবা দিয়েছেন। সুতপাদেবীরা আমাদের গর্ব।’’
এখন টিকাকরণে কর্মসূচিতেও হাজির দিতে হচ্ছে তাঁদের। পুজোয় শুধু অষ্টমীর দিন ছুটি। তবে ছুটিরও ‘দাম’ দিতে হবে। বরাদ্দ উৎসাহ ভাতা থেকে কাটা যাবে ওই দিনের টাকা, জানান সুতপাদেবী। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘সবাই নতুন জামা, শাড়ি পরে মণ্ডপে ঘুরবে। আমরা ব্যস্ত থাকব মানুষের সেবায়। তবে এটাই আমার গর্ব। ঈশ্বরকে বলি, মানুষের জন্য কাজ করার এই সুযোগটা যেন সঙ্গে থাকে আমার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy