Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

ধসের আতঙ্ক, দূষণ নিয়ে বেঁচে রানিগঞ্জ

চার পাশে ঘিরে রয়েছে খনি। দেশে প্রথম কয়লা উত্তোলনও শুরু হয়েছিল এই এলাকাতেই। রানিগঞ্জ তাই পরিচিত ‘খনির শহর’ হিসেবেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরচে পড়েছে রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই শহরের সেই চাকচিক্যে। এক দিকে দুর্গাপুর বা অন্য দিকে আসানসোল শহর যেখানে সময়ের সঙ্গে রূপ পাল্টেছে, সেখানে নাগরিক পরিষেবা হোক বা শহরাঞ্চলের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সব কিছুতেই যেন খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে রানিগঞ্জ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এস জি হিটলি এবং জে সামনারের উদ্যোগে রানিগঞ্জের মঙ্গলপুরে কয়লা খনি চালু হয়। শহর হয়ে ওঠার সেই সূচনা রানিগঞ্জের।

ধোঁয়ায় ঢাকছে আকাশ।

ধোঁয়ায় ঢাকছে আকাশ।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

চার পাশে ঘিরে রয়েছে খনি। দেশে প্রথম কয়লা উত্তোলনও শুরু হয়েছিল এই এলাকাতেই। রানিগঞ্জ তাই পরিচিত ‘খনির শহর’ হিসেবেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরচে পড়েছে রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই শহরের সেই চাকচিক্যে। এক দিকে দুর্গাপুর বা অন্য দিকে আসানসোল শহর যেখানে সময়ের সঙ্গে রূপ পাল্টেছে, সেখানে নাগরিক পরিষেবা হোক বা শহরাঞ্চলের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সব কিছুতেই যেন খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে রানিগঞ্জ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এস জি হিটলি এবং জে সামনারের উদ্যোগে রানিগঞ্জের মঙ্গলপুরে কয়লা খনি চালু হয়। শহর হয়ে ওঠার সেই সূচনা রানিগঞ্জের। এক সময়ে এই শহর ছিল বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত। ১৮৫৫ সালের গোড়ার দিকে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ রেল যোগাযোগ শুরু হয়ে যায়। শহরের এক দিকে দামোদর নদের মাধ্যমে জলপথে, অন্য দিকে রেলপথে যোগাযোগের সুবিধার কারণে এ রাজ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম বড় কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই শহর। তৈরি হয় বড় পাইকারি বাজার।

কয়লা উত্তোলনের জন্য একে একে এগিয়ে আসে নানা সংস্থা। রমরমিয়ে চালু হয় বেশ কিছু খনি। ১৮৩৫ সালে খনি চালু করে কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি, যার অন্যতম অংশীদার ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৬৩ সালে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়ে আসানসোল পর্যন্ত। ১৮৭৬ সালে রানিগঞ্জ পুরসভা গঠিত হয়। পরের বছর এখানে আদালত তৈরি হয়। শহরের চারপাশের খনিতে তখন কাজ করতে আসতেন সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশার মানুষজন। ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে শহর।

১৮৯১ সালে বেঙ্গল পেপারমিল চালু হয় রানিগঞ্জে। গত শতকের শুরুর দিকে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ইউনিট তৈরি হয়। সেখানে টালি ও রিফ্যাক্টরি ব্রিক নানা রাজ্যে বাজার তৈরি করেছিল। ১৯৫০ সালের ২ নভেম্বর ‘রানিগঞ্জ ইউনিয়ন বোর্ড’ গঠনের পরে এই এলাকাকে বর্ধমান জেলার অন্তর্গত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর এবং ১৯৭২ সালের ১ মে দু’টি পর্যায়ে খনি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করার পরে রানিগঞ্জ-সহ গোটা কয়লাঞ্চলের সামাজিক পরিস্থিতি পাল্টায়। পরবর্তী প্রায় দু’দশক ধরে এই শহর অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অনেক উন্নত হলেও তার পরে চিত্রটা বদলাতে শুরু করে।

একে একে বন্ধ হয়ে যায় বেঙ্গল পেপারমিল ও বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ইউনিটে। ফলে, ভিন্ রাজ্য থেকে কর্মসূত্রে এই শহরে লোকজনের আসা কমতে থাকে। শহর ছেড়েও যান অনেকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে খানিকটা ভাটা পড়ায় কাজের সুযোগ কমে। আর তার জেরে বেকারত্ব বাড়ায় এলাকায় শুরু হয় অন্য ধরনের সমস্যা। উঠতে থাকে বেআইনি নানা কাজকর্মের অভিযোগ।

পরিত্যক্ত খাদান। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।

বন্ধ কারখানার আবাসন দখল করে অসামাজিক কাজ-কারবার শুরু হয়। শুরু হয় অবৈধ কয়লার কারবার। অভিযোগ, রাজনৈতিক মদত ও প্রশাসনিক উদাসীনতার জেরে এই কয়লার কারবার যেন বিকল্প অর্থনীতি তৈরি করে ফেলে। এর সঙ্গে যোগ লোহা ও বালি পাচারের বেআইনি কারবারও। দেদার কয়লা কাটার জেরে ধস-ভূগর্ভে আগুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের আগে ব্যক্তি মালিকানাধীন খনিতে অনেক ক্ষেত্রেই কয়লা তোলা হয়েছে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। রাষ্ট্রয়ত্তকরণের পরে অবৈধ খনন বিপদ বাড়িয়েছে। ফলে, অর্ধেক জনপদেই ধস প্রবণতা রয়েছে, ঘোষণা করেছে কয়লা মন্ত্রকই।

১৯৯৭ সালে সিটু নেতা হারাধন রায় শহর বাঁচানো ও নাগরিকদের পুনর্বাসনের দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হন। ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ আদালত ইসিএল-কে এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই মতো ইসিএল বালি ভরাটের কাজ করে। কিন্তু, উপযুক্ত ভাবে সে কাজ না করায় এখনও মাঝে-মাঝে ধস নামে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। পুনর্বাসনের জন্য মঙ্গলপুরে জমি চিহ্নিত করে আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ (এডিডিএ)। সে কাজও আর এগোয়নি। বরং, আগের দশকের গোড়ার দিকে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা গড়ার ঢালাও অনুমতি দেওয়া হয়। মঙ্গলপুর শিল্পতালুকে একে একে পঁচিশটি ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা কারখানা গড়ে তোলে। এডিডিএ-এর অধিগৃহীত জমিতে সাতটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা নির্মাণ হয়। তার পরে পাঁচটি সিমেন্ট কারখানা, তিনটি ইস্পাত কারখানা, একটি বিস্কুট কারখানা, একটা সুজি মিল চালু হয়। ২০০০ সালের গোড়ায় একটি জুটমিল তৈরি হলেও ২০১১ সালের শেষ দিকে সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

কিছু দিন পর থেকেই নানা স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বিরুদ্ধে দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার না করার অভিযোগ উঠতে শুরু করে। প্রতিবাদে কারখানার গেটে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে জেলও খাটতে হয়েছে কিছু বাসিন্দাকে। তাঁদেরই এক জন লুইচাঁদ সূত্রধরের কথায়, “বক্তারনগরে একটি পুকুরে রাজ্য সরকারের সহয়তায় স্থানীয় কয়েক জন সমবায়ের মাধ্যমে মাছচাষে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু এখানে দূষণের মাত্রা এমনই যে কিছু দিনের মধ্যে সব মাছ মরে যায়।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘরের সব জিনিসের রং কালো হয়ে যায়। দূষণের জেরে জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে গিয়েছে।

এক দিকে যখন এই সব সমস্যা নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে, তার সঙ্গে শহরবাসীর সমস্যা বাড়িয়েছে উপযুক্ত নাগরিক পরিষেবার অভাব।

(চলবে)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy