বঙ্কিমচন্দ্র এক বার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘রাঢ়ের মধ্যমণি বর্ধমানের কোনো ইতিহাস নাই।’’
যদিও ‘জৈন আকারঙ্গ সূত্র’ ও ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এ কিছু সাহিত্য-উপাদানে উল্লেখ পেরিয়ে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিজয় সেনের ‘মল্লসারুল লিপি’তে সর্বপ্রথম বর্ধমান-ভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, ‘পুণ্যোত্তর জনপদধ্যাসিতায়াং সতত-ধর্মক্রিয়া বর্ধমানায়াং বর্ধমানভুক্তৌ।’— এর মধ্যেই আগামীর বর্ধমান জেলার প্রথম সূত্র নিহিত রয়েছে। বরাহমিহিরের লেখায় তিনটি জনপদের অন্যতম এই বর্ধমান। পাল-সেন আমলে বর্ধমান-ভুক্তির আরও তিনটি ভাগ জানা যায়, উত্তর রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ় ও পশ্চিম খাটিকা।
নদিয়া আক্রমণ কালে বখতিয়ার খিলজি পেরিয়ে যান বর্ধমান। সুলতানি আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থা ছিল গৌড়কেন্দ্রিক। এই কেন্দ্রীয় চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে শেরশাহের আমলে। সেই আমলে বাংলাকে যে ক’টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়, বর্ধমান তাদের অন্যতম।
ষোড়শ শতকের শেষ দিকে আকবরের আমলে বাংলাকে ১৯টি ‘সরকারে’ ভাগ করা হয়। শরিফাবাদ সরকারের একটি মহল হিসেবে বর্ধমানকে চিহ্নিত করে গিয়েছেন আবুল ফজল। তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ বইয়ে।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল পর্যন্ত বর্ধমানের মানচিত্রের আর কোনও পুনর্বিন্যাস হয় নি। ১৬০৬ সালে কুতুবুদ্দিন খান কোকা বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সেই সময় বর্ধমানের জায়গীরদার ছিলেন শের আফগান। এই শের আফগানের স্ত্রী মেহেরুন্নিসাই পরবর্তী সময়ের নূরজাহান। ১৬২২ সালে শাহজাদা খুররম (পরে শাহজাহান) দাক্ষিণাত্য থেকে তাপ্তী নদী পেরিয়ে ওড়িশার মধ্য দিয়ে বাংলায় এসে বর্ধমান অধিকার করেন। এর পরে ১৬৮৯ সালে আওরঙ্গজেবের ফরমান অনুসারে ঘনশ্যাম রাইয়ের পুত্র কৃষ্ণরাম রাই দু’লক্ষ মুদ্রা নজরানায় বর্ধমান ও অন্যন্য কয়েকটি পরগনার জমিদার এবং চৌধুরী নিযুক্ত হন।
আওরঙ্গজেবের শাসনকালেই ১৭০২ সালে কীর্তিচাঁদ রাই বর্ধমানের জমিদারি লাভ করেন। প্রায় ৩৮ বছর ধরে কীর্তিচাঁদের আমলে ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘটল বর্ধমানের।
১৭৪০-এ নাগপুর থেকে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সময় বর্ধমান জেলার মানচিত্রে কিছুটা প্রভাব পড়ে। ১৭৪২-র এপ্রিল থেকে এই জেলার কাটোয়া অঞ্চল অস্থায়ী ভাবে মারাঠাদের হাতে চলে যায়। ওই বছরই, দুর্গাপুজোর সময়ে গঙ্গা পেরিয়ে কাটোয়ার এক মাইল উত্তরে উদ্ধারণপুরের কাছে আক্রমণ চালিয়ে নবাব আলিবর্দি খান এলাকাটি উদ্ধার করেন।
নবাব আলিবর্দি খান ও রঘুজি ভোঁসলের মধ্যে ১৭৪৫ সালের ডিসেম্বরে কাটোয়ায় একটি যুদ্ধ হয়। ১৭৪৬ সালে ফের একটি যুদ্ধ হয় বর্ধমান শহরের উপান্তে। শেষ পর্যন্ত ১৭৫১-য় তাঁদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়। আলিবর্দি খান রঘুজিকে ১২ লাখ মুদ্রা ‘চৌথ’ হিসেবে দিতে রাজি হন। বাংলা তথা বর্ধমানে মারাঠা সমস্যার সমাধান হয়।
পলাশির যুদ্ধের পরে বর্ধমান রাজপরিবার ও ইংরেজদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। ব্যবসার কারণেই সড়কপথে যুক্ত হয় কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, ঢাকা এবং বর্ধমান। ১৭৬০ সাল নাগাদ মীর কাশিম নবাবির বিনিময়ে মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম-সহ বর্ধমানের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইস্ট কোম্পানিকে উপঢৌকন হিসেবে দেন। মোটামুটি ভাবে এই সময় থেকেই উত্তরে ঝাড়খণ্ডের দুমকা, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণে হুগলি, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্বে নদিয়া ও পশ্চিমে ধানবাদ অঞ্চলকে সীমানা নির্দেশ করে বর্ধমান জেলার বর্তমান মানচিত্র একটা রূপ পায়।
সমৃদ্ধ ইতিহাসের এই জেলা ভাগের প্রাক্কালে স্বস্তির বিষয়, দুই জেলার নামেই বেঁচে থাকছে ‘বর্ধমান’।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy