চলছে হেলমেটের বেচাকেনা।
জীবন শুরু করেছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে। এখন তিনিই হয়ে উঠেছেন এক জন সফল উদ্যোগপতি। তাঁর সংস্থায় তৈরি হেলমেট এখন দেশের ১৫টি রাজ্যে বিক্রি হয়। সংস্থাটির দাবি, প্রতিটি রাজ্যেই ভালই চাহিদা রয়েছে। মাত্র কয়েক হাজার টাকা বিনিয়োগে শুরু করা এই ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার কয়েক কোটি ছুঁয়েছে। চেনা ছকের বাইরে গিয়ে নিজের জীবন পাল্টানোর পাশাপাশি অন্তত দু’শো পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন এই ব্যবসার মালিক বিজয়শঙ্কর বর্মা।
আসানসোলের পাটমোহনা খনি অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের বিজয়শঙ্করবাবুর জন্ম হয় ইসিএলের খনি আবাসনের একটি এক কামরার ঘরে। তাঁর বাবা পরশুরামপ্রসাদ ছিলেন এক জন সাধারণ খনিকর্মী। আসানসোলের কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে বিজয়বাবু বিহারের পটনায় আয়ুর্বেদ পড়তে যান। ফিরে এসে খনি এলাকাতেই চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বেশ কয়েক দশক এ ভাবেই চলে যায়। কিন্তু মন ভরছিল না। হঠাৎ করেই মাথায় এল ব্যবসা করার ভাবনা। তবে ভাবলেই তো আর ব্যবসা করা যায় না! কারণ, কী নিয়ে ব্যবসা করবেন, তা ঠিক করতে পারছিলেন না। শেষে পথ দেখান দিল্লিবাসী এক বাল্যবন্ধু। বছর দশেক ধরে সেই পথে ছুটতে ছুটতে উদ্যোগপতি হওয়ার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছেন বলেই দাবি বিজয়শঙ্করবাবু। তবে তাঁর এই সাফল্যের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছেন বড় ছেলে আশিসকুমার বর্মা।
আশিসকুমার বর্মা ও বিজয়শঙ্কর বর্মা।
কী ভাবে হল এই অসাধ্য সাধন? বিজয়শঙ্করবাবু নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। সময়টা ছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারি। বন্ধুর ডাকে দিল্লি ছুটে গিয়েছেন। দিল্লির কনকনে ঠান্ডায় বন্ধুর এক কামরার ঘরের বারান্দায় কম্বল মুড়ি দিয়ে কেটেছে দিনরাত। বিজয়শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘ব্যবসার শুরুটা মোটেই সুখের ছিল না। ঠিক হল পশ্চিম দিল্লির রণহোলা এলাকার একটি হেলমেট তৈরির কারখানা থেকে পাইকারি দরে হেলমেট কিনে দোকানে দোকানে বিক্রি করব। সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে শুরু করলাম ব্যবসা।’’
কিন্তু মাস কয়েক যেতেই তিনি বুঝলেন এই কারবার তেমন জমে উঠছে না। ফিরেই আসবেন মনস্থির করে বাড়িতে জানালেন সে কথা। তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন বড় ছেলে আশিস। সংসারের হাল ফেরাতে বাবার ব্যবসায় যোগ দিতে তিনিও ছুটলেন দিল্লি। তবে আশিসের ভাবনায় ছিল অন্য পরিকল্পনা। কারখানা থেকে হেলমেট কিনে তিনি বর্ধমান, আসানসোল, ধানবাদের বাজারে বিক্রির জন্য আনলেন। নিজের মোটর সাইকেলে হেলমেটের বোঝা চাপিয়ে দোকানে দোকানে সরবরাহ শুরু করলেন। বছর খানেকের মধ্যেই খনি আবাসনে একটি গুদাম ঘর বানিয়ে সেখানে হেলমেট মজুত করে শিল্পাঞ্চল জুড়ে ব্যবসা জমিয়ে তুললেন।
এখানেই থেমে থাকতে চাননি পিতা-পুত্রের এই জুটি। কারণ, এত দিনে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন তাঁদের দৌ়ড় আরও দূরের লক্ষ্যে। এত দিন যে কারখানা থেকে হেলমেট কিনে দোকানে দোকানে বিক্রি করেছেন, এ বার সেই কারখানাতেই সাধারণ শ্রমিকের চাকরি নিলেন বিজয়শঙ্করবাবু ও আশিসবাবু। পাশাপাশি কর্মচারি দিয়ে দোকানে দোকানে হেলমেট বিক্রির ব্যবসাও চালিয়ে গেলেন। কারখানার চাকরিতে ঢোকার রহস্যটা প্রথম দিকে বোঝা না গেলেও বছর খানেক পরে তা পরিষ্কার হয়ে যায় সহকর্মীদের কাছে। তত দিনে হেলমেট তৈরির যাবতীয় খুঁটিনাটি যে শিখে নিয়েছেন বাবা ও ছেলে।
২০১১-এর গোড়ায় তাঁরা দু’জন চাকরি ছেড়ে পশ্চিম দিল্লির নাগলৈতে খুব অল্প জমি কিনে নিজেদের একটি ছোট হেলমেট তৈরির কারখানা খুললেন। সঙ্গে তিন জন কর্মচারী। মোট পাঁচ জন মিলে কাজ শুরু হল। শুরুতে দৈনিক গড়ে ১০টি হেলমেট তৈরি করতেন। বর্ধমান, আসানসোল, ধানবাদের বাজারে অনেক আগে থেকেই তাঁদের আধিপত্য ছিল। ফলে নিজেদের কারখানায় তৈরি হওয়া হেলমেট বিক্রি করতে তাঁদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। আসানসোলকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারেও ব্যবসা ছড়ালেন।
নিজেদের সংস্থায় তৈরি হওয়া হেলমেটের চাহিদা ক্রমে বাড়তে থাকায় মোটরবাইকের ডিকি তৈরিতেও হাত দিলেন তাঁরা। চাহিদা ও জোগানের সঙ্গে তাল রাখতে ২০১৩-এর জুনে পশ্চিম দিল্লির রণহোলা এলাকায় প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে তৈরি করলেন নতুন আরও একটি কারখানা।
বিজয়শঙ্করবাবু জানালেন, তাঁর প্রথম কারখানায় শ্রমিক ছিল মাত্র তিন জন। এখন তাঁর কারখানায় কর্মীর সংখ্যা একশো ছাড়িয়েছে। দৈনিক গড়ে দেড় হাজার হেলমেট তৈরি হচ্ছে। বার্ষিক টার্নওভার কয়েক কোটি ছুঁয়েছে। এই ব্যবসায় তাঁর অন্যতম অংশীদার আশিসবাবু বলেন, ‘‘আমরা ২০১৪ সালে সরকারি আইএসআই মার্ক পেয়েছি। এখন আমাদের প্রত্যেকটি হেলমেটে সেই চিহ্নের ছাপ দিয়েই বিক্রি হচ্ছে।’’
প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে সফল হওয়া এই জুটি নিজেদের জন্মস্থানকে ভুলে যাননি। বিজয়শঙ্করবাবু জানিয়েছেন, তাঁর সংস্থায় সিংহভাগ শ্রমিক, কর্মী শুধু বাঙালিই নন, আসানসোল শিল্পাঞ্চলেরই। বেছে বেছে বাঙালিদেরই নানা রাজ্যে নিজের সংস্থার বিপণন এজেন্ট নিয়োগ করেছেন তাঁরা।
বিজয়শঙ্করবাবুর সংস্থার অন্যতম প্রধান কারিগর তথা রামপুরহাটের বাসিন্দা সুনীল মণ্ডল বলেন, ‘‘বছর পাঁচেক আগে এখানে চাকরি পেয়েছি। একেবারে বাড়ির মতো পরিবেশ।’’ তিনি কি বাংলায় কারখানা খুলবেন? নিজের বাঙালি স্বত্তা নিয়েও রীতিমতো গর্বিত বিজয়শঙ্করবাবু জানান, দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলে কাঁচামাল সহজে মেলে। তাই আপাতত পশ্চিমবঙ্গে কারখানা খোলার পরিকল্পনা নেই। তবে এই অঞ্চলে ব্যবসা আরও বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘দিল্লির ব্যবসায়ী মহলে অনেকেই আমাকে বাঙালি বলে জানেন। তাঁরা আমাকে বাঙালিবাবু বলেই ডাকেন। এক জন পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে দিল্লির ব্যবসায়ী মহলে জায়গা করে নিতে পেরে আমি খুবই গর্বিত।’’
ছবি: শৈলেন সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy