উত্তরপ্রদেশ থেকে মা ও মেয়ের দেহ নিয়ে আসা হল দুর্গাপুরের রাঁচী কলোনিতে। ভিড় পড়শিদের। ছবি: বিকাশ মশান
দুঃসংবাদটা পৌঁছয় শনিবার সকালে। তার পর থেকেই দুর্গাপুরের ৫৪ ফুট রোডের ধারে রাঁচি কলোনির বাড়িতে ভিড় জমছে দফায়-দফায়। একসঙ্গে মা-মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না কেউ।
দুর্গাপুরের রাঁচী কলোনির মীনা ডোম ও তাঁর মেয়ে মনীষার দেহ উদ্ধার হয় শনিবার ভোরে মথুরার কাছে। তাঁরা রাতের ট্রেনে রাজস্থানের কোটায় যাচ্ছিলেন। অভিযোগ, ট্রেনে তাঁদের ব্যাগ ছিনতাই করে পালানোর সময়ে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি হয়। তখনই দু’জন ট্রেন থেকে কোনও ভাবে পড়ে যান। শনিবার সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ সেই খবর এসে পৌঁছয় রাঁচি কলোনিতে। দুর্গাপুর স্টেশনে দেহ এসে পৌঁছয় রবিবার দুপুরে। সমস্ত নথিপত্রের কাজ শেষ করে বিকেলে দেহ বাড়িতে আনা হয়। তার পরে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, মনীষা আরই কলেজ মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বিধানচন্দ্র ইনস্টিটিউশন ফর গার্লস থেকে ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এর পরে মেডিক্যাল জয়েন্ট্র এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু ভাল র্যাঙ্ক না হওয়ায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাননি।
শোকস্তব্ধ মনীষার বাবা ও দাদা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
মনীষার বাবা দিলীপবাবু গাড়ি চালক। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে বিকাশ বি-টেক পড়ার পরে হায়দরাবাদে এক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। মনীষা সবার ছোট। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘আর্থিক কারণে টিউশন দিতে পারিনি। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছে।’’ তিনি জানান, এ বার মনীষা কোটায় এক সংস্থায় গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১ অগস্ট মাকে নিয়ে মনীষা দিল্লিতে দিদির বাড়িতে যান। সেখান থেকে পর দিন কোটা রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন দিদির ভাসুরের ছেলে আকাশ মল্লিক।
দিলীপবাবাবু বলেন, শনিবার সকাল ৬টা নাগাদ গাড়ি চালানোর সময়ে আকাশ ফোন করে দুঃসংবাদ দেন। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে যা খবর পেয়েছি, ব্যাগটি দুষ্কৃতীরা নিয়ে পালাচ্ছিল। আমার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে তাদের ব্যাগ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। তার পরেই দুর্ঘটনা ঘটে। টাল সামলাতে না পেরে দু’জনে পড়ে যায়, না কি দুষ্কৃতীরা ঠেলে ফেলে দেয়, তা বলা মুশকিল।’’ মনীষার কাকা গণেশবাবু বলেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগত নথিপত্র, সই করা ফাঁকা চেক ছিল ওই ব্যাগে। মনীষার কাছে সেগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।’’ দিলীপবাবুর আক্ষেপ, ‘‘আমার সামান্য রোজগার। আর্থিক পরিস্থিতি মনীষা জানত। তাই হয়তো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সব বাঁচাতে গিয়েছিল। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’’ তাঁর দাবি, রেল কর্তৃপক্ষের উচিত ঘটনার প্রকৃত তদন্ত করে দোষীদের খুঁজে বার করা এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দিলীপবাবুর সঙ্গে দেখা করেন স্থানীয় ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুস্মিতা ভুঁই, মেয়র পারিষদ অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার সকালে তাঁর বাড়িতে যান ২ নম্বর বরো চেয়ারম্যান তথা ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রমাপ্রসাদ হালদার, তৃণমূল নেতা উত্তম মুখোপাধ্যায়, স্থানীয় কাউন্সিলর সুস্মিতাদেবী। রমাপ্রসাদবাবুর অভিযোগ, ‘‘রেলে যাত্রীদের কোনও নিরাপত্তা নেই। আমরা পরিবারটির পাশে রয়েছি। রেল কর্তৃপক্ষ ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করুন, এটাই আমাদের দাবি।’’
মনীষার দিদি পূজাদেবী বলেন, ‘‘মা-বোনকে এক সঙ্গে এ ভাবে হারাতে হবে ভাবতে পারছি না!’’ মনীষার পিসতুতো দিদি সরিকার কথায়, ‘‘মনীষা বলেছিল, ডাক্তার হয়ে এই এলাকার পাশাপাশি অন্য জায়গার গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবে। সব শেষ হয়ে গেল।’’
এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ অজমেঢ় শরিফ-শিয়ালদহ এক্সপ্রেসে দেহ এসে পৌঁছয় দুর্গাপুর স্টেশনে। দেহ আনতে পরিজনদের সঙ্গে স্টেশনে যান শহরের বিধায়ক বিশ্বনাথ পাড়িয়াল, মেয়র দিলীপ অগস্তি। একটি কফিনে দু’টি দেহ এসে পৌঁছনোয় পরিবারের লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অভিযোগ, কফিনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও পাঠানো হয়নি। দুর্গাপুরের স্টেশন ম্যানেজারকে গোটা অব্যবস্থা নিয়ে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়। রেলের আসানসোল ডিভিশনের তরফে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দেওয়া হয়। নিয়মমাফিক নথিপত্রের কাজ শেষ করে বিকেল ৫টা নাগাদ বাড়িতে দেহ পৌঁছতেই কান্নার রোল ওঠে পাড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy