জামালপুরের বসন্তপুরের শিক্ষক। ছবি: জয়ন্ত বিশ্বাস।
অবসর নেওয়ার পরে নিজের চেষ্টায় ব্যবস্থা করে প্রায় দু’বিঘা সরকারি জমিতে টিনের চাল দিয়ে একটি স্কুল ঘর তৈরি করেছেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের বসন্তপুরের অশীতিপর শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ। তাঁর ডাকেই পড়াতে রাজি হয়েছেন স্থানীয় কয়েক জন শিক্ষিত যুবক-যবতী। ইতিমধ্যে স্কুলের উন্নয়নে চার লক্ষ টাকাও খরচ করে ফেলেছেন বৃদ্ধ। তবে চিন্তা একটাই, বছরের পর বছর শিক্ষক ছাড়া স্কুল চলবে কী করে!
বছর পঁচাত্তরের দ্বিজেন্দ্রনাথের ধ্যানজ্ঞান বাড়ির কাছের ওই জুনিয়র হাইস্কুলটি (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত)। জামালপুর হাইস্কুলের থেকে ২০০৮ সালে অবসর নেন তিনি। তবে বিরাম নেই ‘স্যর’-এর। গ্রামে স্কুল তৈরির জন্য কিলোমিটারের পর কিলোমিটার সাইকেলে ঘুরে জন প্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনের দ্বারস্থ হন তিনি। অবশেষে স্কুল শুরু হয় একটি ঘরে।
এখন সেই স্কুল আড়ে-বহরে বেড়েছে। বিধায়ক তহবিল থেকে সরকারের টাকায় বেশ কয়েকটি ঘর হয়েছে। মিড-ডে মিল রান্নার ঘর হয়েছে। কিন্তু স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক নেই। খাতায়-কলমে এক জন মাত্র ‘অতিথি শিক্ষক’ রয়েছেন। এ দিকে স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা ১৪৫ জন। অতএব ভরসা দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং তাঁর মুখ চেয়ে আসা কয়েক জন যুবক-যুবতী।
দ্বিজেন্দ্রনাথ জানান, গ্রামের একটা বড় অংশ তফসিলি ও জনজাতিভুক্ত। প্রাথমিকের পরে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে স্কুলে যেতে হবে বলে অনেকেই স্কুলছুট হয়। তাদের কথা ভেবেই গ্রামে স্কুল গড়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “নানা প্রতিবন্ধকতা সামলে স্কুল হল, মিড-ডে মিল হল, পড়ুয়ারা সরকারি প্রকল্পের সুবিধাও পেল। কিন্তু শিক্ষক ছাড়া কি আর স্কুল চলে! স্থানীয় যুবক-যুবতীরা আর কত দিন বেগার খাটবেন? জানি না, স্কুলটাকে আর বাঁচিয়ে রাখতে পারব কি না।”
স্কুলের প্রথম দিন থেকেই দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে রয়েছেন সুমন মাজি। তিনি বলেন, “জেঠার ডাকেই স্কুলে পড়াতে ঢুকেছি। ওঁর মুখ চেয়ে স্কুল ছাড়তে পারছি না। পড়ুয়াদের ভালবাসারও টান রয়েছে।” ওই স্কুলে পড়ান স্থানীয় দুই শিক্ষিকা। তাঁরাও বলেন, “স্যর এই বয়সে স্কুলের জন্য ছ’সাত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে যান। আমরা কোনও দিন না এলে ফোন করেন কিংবা আমাদের ডাকতে বাড়ি চলে যান।” পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা বলেন, “স্যর না থাকলে আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা বড় স্কুলের মুখ দেখত না।”
সকাল ১০টায় স্কুলে আসেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। প্রয়োজনে স্কুলের দরজা খোলেন, ঘণ্টা বাজান। ইংরেজি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ওই বৃদ্ধ শিক্ষক স্কুলে ইংরেজি-সহ একাধিক বিষয় পড়ান। টিফিনে বাড়িতে খেয়ে আবার পড়াতে শুরু করেন। স্কুল শেষে দরজা লাগিয়ে বাড়ি ফেরেন। ছুটির দিনে তাঁকে স্কুলের শৌচালয়ও পরিষ্কার করতে দেখা গিয়েছে। স্ত্রী গৌরী বলেন, “স্কুলটা ওর নেশা। রাত আড়াইটে পর্যন্ত বাড়িতে বসে স্কুলের কাজ করে। মাঝে মধ্যে রেগে যাই বটে, কিন্তু ছেলে বলে, বাবার তো কোনও নেশা নেই। মানুষ গড়ার নেশাটাই থাক।”
আর ওই শিক্ষক বলেন, ‘‘শুধু লেখাপড়া নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। জানবে, সম্মান করলে সম্মান পাওয়া যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy