আসানসোলে নকড়ি এবং রামকৃষ্ণ রায়ের মূর্তি — নিজস্ব চিত্র।
অজয়-দামোদর নদের সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্থ তুষার যুগ অন্তে। ভূতাত্বিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলে এমনটাই জানা গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে অজয় আর দামোদরের অববাহিকায় সৃষ্টি হয়েছিল বিশাল অরণ্যভূমি। এই অরণ্যভূমির বিস্তার ছিল বর্ধমানের পশ্চিমাঞ্চল সেনপাহাড়ি থেকে বরাকর পর্যন্ত। রানিগঞ্জ-বরাকর অঞ্চলের মধ্যে আসানসোল বনভূমি। এই অঞ্চলে আসন বৃক্ষের আধিক্য হেতু বলা হত আসনসোল বনভূমি। আসনসোলই পরে আসানসোল হয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ভাবে বৃক্ষের নামানুসারে মুর্গাসোল, শিরারসোল প্রভৃতি নামকরণও হয়েছে। কেমন ছিল এই বনভূমি? এক কথায় বলা যায় হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল।
এ বার আসা যাক আসানসোলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। সম্রাট আকবরের সময় অতিক্রম করে আমরা সরাসরি চলে আসি ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে। তখন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ। এই সময়ে পঞ্চকোটের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত শত্রুঘ্নশেখর গড়ুরনারায়ণ সিংহদেও। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বার বার চলে বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামা। বর্গি হাঙ্গামা চলে পঞ্চকোট রাজ্যেও। এই সময়কালে আসানসোল বনাঞ্চলে পঞ্চকোট রাজ্যের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান অর্থাৎ সেনাপতি ছিলেন দুই ক্ষত্রিয়বীর নকড়ি রায় এবং রামকৃষ্ণ রায়।
১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্গিদের একটি দল আসানসোল বনভূমিতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। হানাদার বর্গিদের আসানসোল বনভূমিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন নকড়ি-রামকৃষ্ণ এবং তাঁদের অধীনস্থ পঞ্চকোট সেনাবাহিনী। অনেক রক্ত ঝরেছিল আসানসোল বনভূমিতে। সেই রক্তাক্ত বনভূমিতে দাঁড়িয়ে খুঁজে পাই দু’টি ভিন্নধর্মী ইতিহাস। একটি হল খুন, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও অগ্নি সংযোগের কলঙ্কিত ইতিহাস। এই অমানবিক ইতিহাসের স্রষ্টা ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বাধীন বর্গিবাহিনী। অপরটি হল, বীরত্ব স্বদেশপ্রেমে গৌরবান্বিত উজ্জ্বল ইতিহাস। এই মহান ইতিহাসের স্রষ্টা নকড়ি এবং রামকৃষ্ণ।
নকড়ি এবং রামকৃষ্ণের বীরত্ব এবং স্বদেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে পঞ্চকোটের মহারাজা গড়ুরনারায়ণ সিংহদেও তাঁদের আসানসোল বনাঞ্চলের বিস্তৃত অঞ্চল জায়গির দান করেন ৩৭৬।২ (তিন শত ছিয়াত্তর টাকা চার আনা দুই পাই) জমায়। সরকারি দলিল পর্চায় উল্লেখ আছে এই অঞ্চলটি জলা মানভূম, পরগানা শেরগড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চল পঞ্চকোট রাজ্যের অধীন।
অতঃপর জায়গিরদার নকুড় এবং রামকৃষ্ণ বন কেটে গ্রামের পত্তন করেন। আসন বন কেটে সোল জমিতে গ্রামের পত্তন— তাই গ্রামের নাম রাখেন আসনসোল। আসনসোল অপভ্রংশে আসানসোল হয় পরে। আসানসোল গ্রাম যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সময় আশেপাশে আর কোনও গ্রাম বা জনপদ গড়ে ওঠেনি। সবচেয়ে কাছের গ্রাম বলতে সেই সময়ে পশ্চিমে নিয়ামতপুর এবং পূর্বে রানিগঞ্জের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আসানসোল গ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের রূপ দিতে বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন পেশার লোকজনদের এনে, তাঁদের জায়গা দিয়ে বসতি গড়া হয়। এঁদের মধ্যে আছেন ব্রাহ্মণ, কামার, কুমোর, ধোপা, নাপিত, তাঁতি, ডোম, মুচি, বাউড়ি-সহ নানান জনগোষ্ঠীর মানুষজন। শান্ত স্নিগ্ধ ছায়া সুনিবিড় বনাঞ্চলে গড়ে উঠল আসনসোল গ্রাম। খনন করা হয় পদ্মবাঁধ, রাম সায়র, সীতা সায়রের মতো বিশাল বিশাল জলাশয়। প্রতিষ্ঠিত হল বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির। এই তথ্যগুলি উঠে এসেছে গবেষক এবং ইতিহাসবিদদের কলমে। সেগুলো পড়েই আমরা পুরনো আসানসোল সম্পর্কে জানতে পারি। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আসানসোল গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কয়লাখনি, এসেছে রেল, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিল্প-কলকারখানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy