বাজি বিস্ফোরণে সব হারানো কালনার মহামায়া সাঁতরা। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল
অ্যাসবেস্টসের চালের গা ঘেঁষে ছোট্ট রান্না ঘর। বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রান্নার কাঠ, ঘুঁটে। দড়িতে ঝুলছে রংচটা শাড়ি, গামছা। মোটা সুতোর শাড়ি জড়িয়ে দাওয়ায় বসে রয়েছেন বৃদ্ধা। দশ বছর আগের এক আশ্বিনের পর থেকে জীবন যেন থমকে গিয়েছে তাঁর।
২০১৩ সালে বেআইনি বাজি বিস্ফোরণে স্বামী, ছেলে, বৌমাকে হারান কালনা ২ ব্লকের আনুখালের মহামায়া সাঁতরা। স্বচ্ছল সংসারে যেন আঁধার নামে। এখন প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে জীবন বয়ে বেড়ান তিনি। বৃদ্ধা বলেন, ‘‘ওই দিন ঘরের জানালার শিক বাঁকিয়ে কোনও রকমে শরীরটা বাইরে বার করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাড়ির বাকিরাও ঠিক বেরিয়ে যাবে। বুঝতে পারিনি বাজির আগুনে সংসারটাও পুড়ে যাবে আমার।’’
কালনা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের আনুখালে এক সময়ে বেশ কিছু মানুষ বাজি তৈরি করতেন। উৎসবের আগে প্রকাশ্যে, চোরাগোপ্তা ভাবে বাজি কিনতে আসতেন অনেকে। তবে ২০১৩ সাল ওই ঘটনার পর থেকে প্রকাশ্যে বাজির কারবার বন্ধই। যাঁরা ওই কাজ করতেন অনেকেই চাষবাস, মাছধরার কাজে ঢুকে গিয়েছেন। মহামায়া জানান, তাঁর স্বামী আনন্দ সাঁতরা মাছ ধরতেন। ছেলে মানিকের ফুচকার ব্যবসা ছিল। বাড়তি আয়ের আশায় ঘটনার বছর দুয়েক আগে থেকে পুজোর আগে চকোলেট বোমা, আতসবাজি বানাতে শুরু করেন তাঁরা। আরও কয়েক জন এসে তাঁদের বাড়িতে কাজ করতেন। বাড়ির উঠোনে শুকোত বারুদ, সলতে।
বৃদ্ধা বলেন, ‘‘সে বার আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। ক’দিন বাদেই পুজো। বাড়িতে অনেক বাজি ছিল। দুপুরে স্বামী এক ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন। ছেলে-বৌমা ছিল অন্য ঘরে। আমিও ঠাকুরকে জল দিয়ে তক্তায় শুয়েছিলাম। হঠাৎ গোটা ঘর ধোঁয়ায় ভরে যায়। দরজা দিয়ে বার হতে না পেরে কোনও রকমে জানলার শিক বেঁকিয়ে শরীরটা ঝুলিয়ে দিই। এক প্রতিবেশী আমায় নীচে নামান।পরে জানতে পারি, বিস্ফোরণের পরে ছেলে, বৌমা বার হতেই পারেনি।’’ হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন ঘটনার পরের দিন মারা যান তাঁর স্বামীও। দুই নাতি স্কুলে থাকায় বেঁচে গিয়েছিল। সাবালক হওয়ার আগেই পেটের টানে ওই দুই ভাই সাইকেল এবং কাঠের সরঞ্জাম তৈরির দোকানে কাজ করে। মহামায়া বার্ধক্য ভাতা পান। তবে তাতে মাস চলে না। এ পাড়া, ও পাড়ায় ভিক্ষে করে পেট চালান তিনি।
বৃদ্ধা বলেন, ‘‘ছেলেকে অনেক বার বারণ করেছিলাম। শোনেনি। এখন সবাইকে বলি, আর যাই কাজ করো, এ পেশায় এসো না।’’
ধুলাগড়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত তরুণী দেবী ধারা মাঝেমধ্যেই দিদার কাছে আসেন। এ দিনও মহামায়ার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘দেড় বছর বয়স থেকে মামার বাড়িতে থাকতাম।ঘটনার সময় কালনা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। কলেজ থেকে ফিরে মামা-মামির পুড়ে যাওয়া নিথর দেহ দেখেছিলাম। সব যেন কেমন হয়ে গেল!’’ ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন এলেই দগদগে ক্ষতগুলো টাটকা হয়ে ওঠে ওঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy