ঘটনা ১: কয়েক মাস আগে এক ম্যাজিস্ট্রেটের সই জাল করে হলফনামা বেরিয়েছিল। সইটা প্রায় একই রকম ছিল। কিন্তু বাধ সেধেছিল পেনের কালি! ওই শংসাপত্র হাতে পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট জানিয়েছিলেন, তিনি ওই রঙের কালি ব্যবহারই করেননি।
ঘটনা ২: দশ টাকার স্ট্যাম্পের উপরে সরকারি সিল ও রেজিস্টারে ক্রমিক নম্বর (১০৯১১) দেওয়া একটি হলফনামা রয়েছে রায়নার সেহেরার জনৈক বিকাশ হাজরার। কিন্তু বর্ধমানের এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের রেজিস্টার বলছে, ওই ক্রমিক নম্বরটি ভাতারের জনৈক এস সামন্তের। যার অর্থ, রায়নার ওই বাসিন্দার কাছে থাকা হলফনামাটি জাল।
এক এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তথা জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সই জাল করে হলফনামা বেরিয়েছে দাবি করে শনিবারই বর্ধমান থানায় চিঠি দিয়েছেন এসডিও (বর্ধমান সদর) তীর্থঙ্কর বিশ্বাস। তিনি চিঠিতে বর্ধমান থানার আইসিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশের পাশাপাশি জেলাশাসক আয়েষা রানি এ প্রশাসনিক স্তরে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
বর্ধমানের এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট থেকে জাল শংসাপত্র বেরোনোর অভিযোগ এই প্রথম নয়। বর্ধমানের বার অ্যাসোসিয়েশন কয়েক বছর আগে এসডিও-র (বর্ধমান উত্তর) সঙ্গে দেখা করে জাল হলফনামার সঙ্গে কোর্টের কর্মীদের একাংশ জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। কোনও রেজিস্টার না থাকায় কী ভাবে হলফনামা হচ্ছে, তা ধরাও পড়ছে না। পরবর্তী সময়ে ওই সব হলফনামার মধ্যে জাল বেরোচ্ছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, দেড় দু’বছর আগে এগজ়িকিউটিভ কোর্টে রেজিস্টারে হলফনামা নিবন্ধীকরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু তার পরেও জাল হলফনামা যে হচ্ছে, পর পর দু’টি ঘটনাতেই তা প্রমাণিত।
প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “জাল হলফনামা ধরার বাস্তবিকই কোনও উপায় নেই। ঘটনাচক্রে, ওই সব ম্যাজিস্ট্রেট তথা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দফতরেই হলফনামাগুলি জমা পড়ায় বেনিয়ম ধরা পড়েছে। অন্য কোনও দফতরে সেগুলি জমা পড়লে, ধরা পড়ত না।”
বর্ধমান বার অ্যাসোসিয়েশন বা ল’ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, বিমা সংস্থার টাকা পেতে, চাকরির প্রয়োজনে, পাসপোর্ট করাতে, জমির উত্তরাধিকার, জন্মমৃত্যু সংক্রান্ত শংসাপত্র বা অন্য বিষয়ের জন্যও সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রথম শ্রেণির এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের সই করা হলফনামা প্রয়োজন হয়। বর্ধমানে দুপুর ১২টার মধ্যেই হলফনামার জন্য যাবতীয় তথ্য এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমা দিতে হয়। আবেদনকারীকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এজলাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। তার পরে হলফনামা পাওয়া যায়। এটাই নিয়ম। কিন্তু ৮০০-৯০০ টাকা খরচ করলেই বর্ধমানের এগজ়িকিউটিভ কোর্ট থেকে এক ঘণ্টায় হলফনামা পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ!
এই ধরনের হলফনামাগুলি পুরোপুরি জাল বলে মানছে আইনজীবী ও ল’ক্লার্কদের সংগঠন। তাদের দাবি, আইনজীবী, ল’ক্লার্কের একাংশের সঙ্গে এগজ়িকিউটিভ কোর্টের কয়েক জন কর্মী জাল হলফনামা-কাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন। তা না হলে সরকারি স্ট্যাম্প কিংবা সংশ্লিষ্ট দিনে কত ক্রমিক নম্বর পর্যন্ত হলফনামা দেওয়া হয়েছে, তা বাইরে বেরোচ্ছে কী ভাবে?
বর্ধমান বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরূপ দাস বলেন, “পরিকাঠামোর অভাবের সুযোগ নিচ্ছেন কেউ কেউ। ম্যাজিস্ট্রেটরা কোর্টে আসছেন দু’টো-আড়াইটের সময়ে। দূর-দূরান্তের আবেদনকারীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকার ধৈর্য্য রাখতে পারছেন না। সেই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে একটি চক্র।”
আইনজীবী ও ল’ক্লার্কদের দাবি, জেলা কোর্ট চত্বরের শনি মন্দির, জেলা পরিষদের গেট, সেচ দফতরের অফিসের কাছেই জাল হলফনামা চক্রের ‘ঠেক’। জাল হলফনামা পাওয়া এক মহিলার দাবি, “আইনজীবীই নিয়েছেন ৫০০ টাকা। এর বাইরে মুহুরি, টাইপ করানো-সহ আরও ৩০০ টাকা খরচ হয়েছে। ওই হলফনামা নেওয়ার ঝামেলা আমাকে এখনও পোয়াতে হচ্ছে।” বর্ধমান বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সদন তা বলেন, “এ ধরনের প্রতারণা আটকাতে হলফনামায় বার অ্যাসোসিয়েশনের স্ট্যাম্প রাখার জন্যে প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে। তাতে আমাদেরও দায়িত্ব বাড়বে।” ল’ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি বিপদতারণ আইচের কথায়, “এ ধরনের প্রতারণা আটকাটে প্রচার প্রয়োজন।”
প্রশাসনের এক আধিকারিক পরিকাঠামোর অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন। তিনিও বলেন, “দুপুর ১২টা পর্যন্ত হলফনামার তথ্য জমা নেওয়া হয়। তার পরে যাঁরা আসেন, তাঁরাই সম্ভবত অসাধু চক্রের পাল্লায় পড়েন। কর্মীদেরও সতর্ক করা হচ্ছে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)