জেকে নগরে বন্ধ রোলিং মিল।
এক দিকে তিরিশ বছর ধরে মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকা ইস্কো কারখানার পুনরুজ্জীবনের জন্য উঠেপড়ে লাগল কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রক। অন্য দিকে ধুঁকতে থাকা ইসিএলকে লাভজনক করে তোলার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নিল কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক। এই শতকের গোড়ায় দুই সংস্থার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হতেই ভোল পাল্টাতে শুরু করল আসানসোলও।
শিল্পাঞ্চল এলাকায় শিল্পের উন্নতিই অর্থনৈতিক উন্নতির উপায়। শিল্প সংস্থা ঘুরে দাঁড়ালে বাইরে থেকে মানুষের যাতায়াত, বসবাস বাড়ে। চাহিদা পূরণে তৈরি হয় দোকানপাট, গড়ে ওঠে বাজার। দুই সংস্থার পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পরে সেই চিত্রই দেখেছিল আসানসোল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আলো দেখায় গড়ে উঠেছিল নানা অনুসারী শিল্পও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সব শিল্পে দেখা দিয়েছে মন্দা। ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি কারখানাও। গড়ে ওঠা শিল্পতালুকের চেহারাও তাই ম্রিয়মাণ। বেসরকারি ক্ষেত্রে শিল্পের চেহারাটা অন্য রকম হলে শহরের বাজারের চেহারা আরও উজ্জ্বল হত, মনে করে নানা মহল।
২০০৬ সালের শেষ দিকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার (সেইল) মাধ্যমে বার্নপুরের ইস্কো কারখানা আধুনিকীকরনের কথা ঘোষণা করেন। পরের বছর ২৪ ডিসেম্বর দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বার্নপুরে এসে ইস্কোর নতূন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পথচলা শুরু হয় ইস্কোর। কয়েক হাজার মানুষ কর্মসূত্রে আসানসোলে ডেরা বাঁধলেন। চাঙ্গা হয়ে উঠল বাজার। বার্নপুরের কারখানা পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে ইস্কোর কুলটি ইউনিটটিরও ভাগ্য ঘুরতে শুরু করল। ২০০৩ সালের ৩১ মার্চ এই ইউনিটের ৩১০০ শ্রমিক-কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর দিয়ে সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। সেই কারখানা ২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ফের খুলে দিল ইস্পাত মন্ত্রক। ঠিকা প্রথায় হলেও কাজ পেলেন কয়েকশো মানুষ।
প্রায় তিরিশ বছর ধরে লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা উত্তোলক সংস্থা ইসিএল চলে গিয়েছিল বিআইএফআর-এর অধীনে। কয়লা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নেয়, সংস্থাটিকে ঘুরে দাঁড় করাতে হবে। নতুন খনি খোলার পাশাপাশি অলাভজনক খনিগুলিতে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কয়লা তুলে লাভের মুখ দেখা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খনিগুলির উৎপাদন ব্যয় কমানোর নীতি নেওয়া হয়। ২০০৪ সাল থেকে ইসিএলের সময় ফিরতে থাকে। দু’বছর পর থেকেই সংস্থা লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেব্লস কারখানা উৎপাদন শূন্য হয়ে থাকলেও চিত্তরঞ্জনের রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানাতেও বিনিয়োগ বাড়ায় রেল মন্ত্রক। ফলে, সেখানকার পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে।
ইস্কো-ইসিএলের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রভাব বছর দশেক আগে গিয়ে পড়েছিল নাগরিক জীবনেও। এ ব্যাপারে ভূমিকা নিয়েছিল ঝাঁ চকচকে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে যোগাযোগের সুবিধাও। বিনিয়োগ বাড়ল শিক্ষাক্ষেত্রেও। ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসি-সহ একাধিক কলেজ, কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুল তৈরি হল আসানসোলে। নানা প্রবেশিকা ও চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণের জন্য আগে এখানকার পড়ুয়াদের ছুটতে হত কলকাতা বা অন্যত্র। কিন্তু একে একে আসানসোলেও খুলল এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ধাদকায় বন্ধ নীল কারখানা।
প্রচুর কয়লা ও ইস্পাত সহায়ক শিল্প তৈরির প্রবণতা দেখে এই শিল্পাঞ্চলের মঙ্গলপুর, জামুড়িয়া, কল্যাণেশ্বরী ও আসানসোলে একাধিক শিল্পতালুক গড়ে তোলে তৎকালীন রাজ্য সরকার। বেশ কিছু কারখানাও তৈরি হয়। কুলটি, বারাবনি, সালানপুরে তৈরি হয় প্রচুর রিফ্যাক্টরি। বছর সাতেক রমরম করে চলেছে এই সব কারখানা। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে ফের মন্দার কবলে সেগুলি। নানা কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, এর একটি কারণ যদি হয় শ্রমিকদের আন্দোলন-বিক্ষোভ, অন্যটি অবশ্যই শিল্পতালুকগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব। আসানসোলের কন্যাপুর শিল্পতালুকের প্রথম কারখানার মালিক তথা আসানসোল ইন্ডাস্ট্রিয়াল চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি অধীর গুপ্ত যেমন বলেন, “এটা নামেই শিল্পতালুক। পানীয় জল, রাস্তা, রাস্তার আলো, নিকাশি কিছুই নেই। এখানে কেন শিল্পপতিরা কারখানা চালাবেন?” এই শিল্পতালুক থেকে প্রায় ৪০টি ছোট-বড় শিল্প অন্যত্র চলে গিয়েছে বলে বণিকসভা সূত্রে জানা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কারখানায় জুলুমের অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে বলে অভিযোগ। ফেডারেশন অব সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ খেতানের দাবি, “সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে না। শিল্পপতিরা কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। সরকারের তরফে শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা খুব জরুরি।”
এই পরিস্থিতিতে আসানসোলের চেহারা খানিকটা উন্নত করতে পারত আশপাশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে নানা পরিকল্পনা। কিন্তু সেখানেও তেমন আলো ফোটেনি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy