ভগ্নদশা নেহরু স্টেডিয়ামের।
সালটা ১৯৮৯। জওহরলাল নেহরুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মুখোমুখি গাভাসকার একাদশ ও কপিল দেব একাদশ। মাঠে কে নেই! গাভাসকার, কপিল দেব, রবি শাস্ত্রী, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সন্দীপ পাটিল, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, মদনলাল, অরুণলাল, কীর্তি আজাদ, চেতন শর্মা, কারসন ঘাউড়ি, সৈয়দ কিরমানি, অজয় শর্মা। প্রাণ ভরে দেখেছিল দুর্গাপুর।
তার ঠিক ছ’বছর পরের কথা। কোচবিহার ট্রফিতে বাংলা বনাম বিহারের ম্যাচ। তিন দিন স্টেডিয়াম ভরিয়ে খেলা দেখেছিল শহর।
২০০৪ সালে বসল একটা গোটা টুর্নামেন্টের আসর। ইস্টবেঙ্গল ছাড়া কলকাতার অন্য বড় দলগুলি নামল এই শিল্পশহরের মাঠে। ফাইনালে মোহনবাগান ৩-০ গোলে হারিয়ে দিল জর্জ টেলিগ্রাফকে।
খেলাধুলোর এমন বড় আসর এক সময়ে কম দেখেনি। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের (ডিএসপি) নেহরু স্টেডিয়ামে এই ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্সের চর্চা হত নিয়মিত। ইস্পাতনগরীর এ-জোন এবং বি-জোনের সংযোগস্থলে সাতের দশকের গোড়ায় গড়ে ওঠে স্টেডিয়ামটি। ১৯৭৫-এ অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯৭৬ ও ১৯৮৫ সালে নিউজিল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেট দল এই মাঠে খেলে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ ছিল পূর্বাঞ্চল। তার পরেও নানা প্রতিযোগিতা, বড় খেলা হয়েছে। কিন্তু সেই স্টেডিয়ামের গ্যালারির এখন ভগ্নদশা। মাটি থেকে আগাছা মাথা উঁচিয়ে গ্যালারির উপরে পৌঁছেছে। মাঠের হাল বেশ খারাপ। স্কোরবোর্ড সেই মান্ধাতা আমলের। মাঝে মাঝে খুচখাচ সংস্কার যে হয় না তা নয়। তবে আমূল সংস্কারের আশু কোনও সম্ভাবনা শোনায়নি।
নয়ের দশকের শেষ দিক থেকে দুর্গাপুর শহরের অর্থনৈতিক চালচিত্র পাল্টাতে শুরু করে। কলকাতার পরে দুর্গাপুরকে রাজ্য সরকার দ্বিতীয় বড় শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেছে নেয়। ২০০৬ সালে শহরে একটি আর্ন্তজাতিক মানের স্টেডিয়াম গড়ার পরিকল্পনা করে পুরসভা। ঠিক হয়, জাতীয় সড়কের ধারে ভগত্ সিংহ মাঠে সেই স্টেডিয়াম হবে। মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় একুশ একর জমিতে স্টেডিয়াম, গ্রিন গ্যালারি, ক্লাব হাউস, কমেন্ট্রি বক্স, প্রায় চব্বিশ হাজার দর্শকের খেলা দেখার ব্যবস্থা। বাজেট ধরা হয় সাড়ে বাইশ কোটি টাকা। তা জোগাড় করার জন্য দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিল্প সংস্থার কাছে সহযোগিতা চায় পুরসভা। কিন্তু সে ভাবে সাড়া মেলেনি। তবে আর্ন্তজাতিক মানের মাঠ তৈরি থেমে থাকেনি। রেলিং দিয়ে ঘেরা মাঠ, বৃষ্টি হলে দ্রুত জল নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা, পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক ড্রেসিংরুমসবই রয়েছে। মোহনবাগান দুর্গাপুরে আবাসিক শিবির করতে এলে এই মাঠটি ব্যবহার করে। ব্যারেটো, ওডাফা, কারিম বেঞ্চারিফারা মাঠের প্রশংসা করে গিয়েছেন। কিন্তু বড় কোনও খেলার আসর এই মাঠে আয়োজিত হয়নি এখনও। উল্টে, স্টেডিয়ামের এক পাশ শহরের বর্জ্য ফেলা বা জলপ্রকল্পের পাইপ ডাঁই করে রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। স্টেডিয়াম ঘিরে আর কোনও উদ্যোগ কোনও তরফে দেখা যায়নি বলে খেদ রয়েছে শহরের ক্রীড়াপ্রেমীদের।
সিধো-কানহু ইন্ডোর স্টেডিয়াম, যার পরিকাঠামো নিয়েও নানা প্রতিযোগিতা চলাকালীন অভিযোগ উঠেছে।
শহরের একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়ামটি রয়েছে সিটি সেন্টারের ক্ষুদিরাম সরণিতে। রাজ্যের অন্যতম সেরা এই সিধো-কানহু স্টেডিয়ামটি ১৯৭৯ সালে তৈরি হয়। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ব্যবহারের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছিল সেটি। ফলে, কোনও বড় প্রতিযোগিতা আয়োজনের ঝুঁকি নিতে চাইতেন না উদ্যোক্তারা। শেষে ২০১১ সালে পুরসভা প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সেটির সংস্কার করে। প্রায় সাড়ে চার হাজার আসনের ঝকঝকে গ্যালারি, আধুনিক আলো-সহ নানা ব্যবস্থা হয়। কাঠের মেঝেয় টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সেখানে অনূর্ধ্ব ১৩ ও অনূর্ধ্ব ১৫ পুরুষ ও মহিলা বিভাগের ‘অল ইন্ডিয়া সাব জুনিয়র র্যাঙ্কিং ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট’ আয়োজিত হয়। কিন্তু অব্যবস্থার অভিযোগ এড়ানো যায়নি। লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর চালিয়ে খেলা হয়। কিন্তু ভিতরের বাতাস বের করে দেওয়ার পাখা কাজ না করায় বিপাকে পড়েন প্রতিযোগীরা। স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে বহু প্রতিযোগী। এই বছর অক্টোবরের শেষে আয়োজিত হয় ‘জাতীয় পূর্বাঞ্চলীয় র্যাঙ্কিং টেবিল টেনিস’। তখনও স্টেডিয়ামের ভিতরে আবহাওয়া বেশ গরম হয়ে যাচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। হাতপাখা নিয়ে বসেছিলেন অনেক দর্শক।
কোনও স্টেডিয়াম অবহেলায় পড়ে। কোনও স্টেডিয়াম আবার দেখতে ঝকঝকে হলেও ঠিক মতো ব্যবহার হয় না। কোথাও আবার রয়েছে পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ। ক্রীড়াপ্রেমীদের অভিযোগ, দুর্গাপুর বড় খেলার আসর থেকে অনেক দিন ধরেই বঞ্চিত। শহরের মেয়র তথা বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ভগত্ সিংহ স্টেডিয়ামের পরিকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সিধো-কানহু স্টেডিয়ামটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হবে। তবে পুরসভার হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। মেয়র বলেন, “রাজ্য সরকারের কাছে বিশদ পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই কাজ হবে।” শহরবাসী অবশ্য বলছেন, শুধু স্টেডিয়ামের দুর্দশা নয়, শহরের খেলাধুলোর সেই গরিমাই এখন আর নেই।
(চলবে)
ছবি: বিকাশ মশান ও সব্যসাচী ইসলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy