কখনও ফেসবুকে ‘বিদ্রোহী’ পোস্ট। কখনও নিজের সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিপ্লবাত্মক’ বিবৃতি। কখনও দলের কোনও নেত্রীকে ‘অসৎ’ বলে সর্বসমক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা। কখনও সমাজমাধ্যমে অশালীন ভাষা ব্যবহার। কখনও রিকশা চালিয়ে এমএলএ হস্টেল থেকে বিধানসভায় আসা। বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী শাসক শিবিরের অন্দরে ‘বিতর্কের ব্যাপারী’ ছিলেনই। কিন্তু নিজের দলের অন্দরে তাঁকে নিয়ে যে ক্ষোভ, তার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে যখন তিনি বিধানসভার অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য নিজস্ব পতাকার দাবি তুললেন।
পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে আবার টিকিট দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়েও দলের অন্দরে গুরুত্ব দিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। দলের শীর্ষ স্তরের একাধিক নেতা মনে করছেন, বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক দিনে দিনে ‘বোঝা’ হয়ে উঠছেন! মনোরঞ্জনকে নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বহু বার। কখনও কড়া, কখনও নরম ভাবে সতর্কও করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এ বার তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁর বিষয়ে ‘উদাসীন’, যা থেকে তৃণমূলে তাঁর পরিষদীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
বুধবার বিধানসভার উল্লেখপর্বে পশ্চিমবঙ্গের জন্য পৃথক পতাকার দাবি জানান মনোরঞ্জন। তাঁর বক্তব্য, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব পতাকা রয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের জন্যও নতুন পতাকা প্রয়োজন। যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের জন্য পৃথক সঙ্গীত করেছেন, সে ভাবেই তৈরি হোক রাজ্যের জন্য আলাদা পতাকা। মনোরঞ্জনের ওই বক্তব্যের সময় স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। মনোরঞ্জনের প্রস্তাব শুনে তিনি খানিকটা হকচকিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গেই অধিবেশনের বিরতি ঘোষণা করে দেন তিনি। পরে ওই দাবি প্রসঙ্গে ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘‘অন্য রাজ্যের রাজ্য সঙ্গীত আছে বলে আমি জানি। তবে অন্য রাজ্যের পৃথক পতাকা আছে বলে আমার জানা নেই।’’
মনোরঞ্জনের পতাকা-মন্তব্যকে ‘হাতিয়ার’ করে আক্রমণ নেমেছে বিজেপি। বহরমপুরের বিধায়ক কাঞ্চন মৈত্রের কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গকে যে তৃণমূল সরকার পশ্চিম বাংলাদেশ তৈরি করতে চাইছে, তা বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়কের বিধানসভার বক্তৃতা থেকেই স্পষ্ট। কারণ, ভারতের কোনও রাজ্যের পৃথক পতাকা নেই। একটি বিশেষ ক্ষমতাবলে জম্মু-কাশ্মীরের একটি পৃথক পতাকা ছিল। কিন্তু ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর সেই পতাকাও বিলুপ্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গকে কি নতুন কাশ্মীর করতে চাইছে তৃণমূল? কারণ, ওই কথাগুলো বিধানসভার কার্যবিবরণীতে রয়ে গিয়েছে।’’
মনোরঞ্জনের পতাকা-দাবির কথা জেনে বিধানসভায় থাকা মন্ত্রীরাও ক্ষুব্ধ হন। বস্তুত, ওই বিষয়ে দলের কেউ প্রতিক্রিয়াও জানাতে চাননি। ‘বিরক্ত’ নেতৃত্বের কেউ মনোরঞ্জনের সঙ্গে ওই বিষয়ে কথাও বলেননি। তৃণমূল পরিষদীয় দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান তথা পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও নন।
২০২১ সালে বলাগড়ের তৎকালীন বিধায়ক অসীম মাজিকে সরিয়ে মনোরঞ্জনকে প্রার্থী করে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী সুভাষচন্দ্র হালদারকে ৫,৭৮৪ ভোটে হারিয়ে বিধায়ক হন তিনি। কিন্তু অভিযোগ, জিতেই বলাগড়ের স্থানীয় গোষ্ঠী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মনোরঞ্জন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ফেসবুকে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। সেই পোস্টে মন্তব্যের জবাবে তিনি অশালীন ভাষা ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। বলাগড় এলাকায় বিধায়কের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
আরও পড়ুন:
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সমাজমাধ্যমেই মনোরঞ্জন লিখেছিলেন, দলের এক নেত্রী ঘুষ দিয়ে পদে আসীন হয়েছেন এবং কাজ না করেও বেতন পাচ্ছেন। তিনি ওই বিষয়ে কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন, যা নিয়ে দলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পরে নভেম্বর মাসে মনোরঞ্জন সমাজমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গটাও খুনি-ধর্ষকদের উল্লাসভূমি হয়ে গেল নাকি?’ বিজেপি নেতারা ওই মন্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, “মাঝেমধ্যে ওঁর বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঠে।” সম্প্রতি আমিষ-নিরামিষ বিতর্কে দলের সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হাকেও প্রকাশ্যেই আক্রমণ করেছেন মনোরঞ্জন।
তিনি কি আদতেই দলের বোঝা হয়ে উঠছেন? আনন্দবাজার অনলাইনে এই প্রশ্নের জবাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বলাগড়ের বিধায়ক। তবে তৃণমূলের এক শীর্ষনেতা বলছেন, ‘‘টিকিট দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের লোকদের থেকে দলের সাবধান হওয়া উচিত। এঁরা দলের আদর্শ বা নীতির তোয়াক্কা করেন না। যে কোনও জনপ্রতিনিধিকে কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব মেনে চলতে হয়। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো মানুষেরা কিছুই মানতে চান না, যা মাঝেমধ্যেই দলের অস্বস্তির কারণ হয়।’’ ওই নেতার সংযোজন, ‘‘বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও বলাগড়ের বিধায়ক শিক্ষা নেননি। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট দেওযার সময় দল সেটা মাথায় রাখবে বলেই আমরা মনে করি।’’