বাবুল সুপ্রিয়
‘রাজনীতি-পরবর্তী জীবনে’ যে পাঁচটি বিষয় নিয়ে লিখব ঠিক করেছিলাম, তার মধ্যে চারটি বিষয়ে ইতিমধ্যেই লিখেছি। পাঁচ নম্বর বিষয় ‘টালিগঞ্জ’ নিয়ে একদম শেষে লিখব ভেবেছিলাম। লিখছি। আর এটাই শেষপর্ব। খুব দরকার না হলে বা কিছু লেখার একান্ত ইচ্ছা বা তাগিদ অনুভব না করলে রাজনীতি নিয়ে আর বিশেষ কিছু লিখব না।
প্রসঙ্গত, আনন্দবাজার অনলাইন আমার কাছে জানতে চেয়েছে, সম্প্রতি আমাকে আমাদের জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার বাড়িতে দেখা গিয়েছে। কেন? এটা সত্যি যে, নড্ডাজি আমাকে স্নেহ করেন। উনি ডেকেছিলেন এবং আমি গিয়েছিলাম। অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তার মধ্যে রাজনীতি না খোঁজাটাই ভাল। রাজনীতি থেকে আমি আপাতত অনেকটাই দূরে। তবে হ্যাঁ, আমি রাজনীতির যে যে ঘটনাগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত, সেই ঘটনাগুলি সম্পর্কে আমার যা যা লেখার বা আমার যে অভিজ্ঞতাগুলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলে ভাল হবে বলে আমি মনে করি, সেগুলো আমি নিশ্চয়ই লিখতে থাকব। একটু হলেও মানুষ যদি তার থেকে কোনও ভাবে ভবিষ্যতে উপকৃত হন বা কোনও বিষয়ে অবহিত হন, তা হলে সেটা আমার সৌভাগ্য।
প্রথমেই বলি, আমি কোনও ভাবেই মনে করি না টালিগঞ্জের মানুষ আমাকে ৫০,০০০ ভোটে হারানোর জন্য ভোট দিয়েছেন। বাস্তব হল, ওখানে প্রচুর ভোট আমি পেয়েছি। কিন্তু ভোটগণনাটা আমাদের নতুন ছেলেরা সামলাতে পারেনি। তবে ওদের দোষ দেওয়া অত্যন্ত অন্যায় হবে| ওরা ওদের সবটুকু দিয়েছে। কিন্তু শাসকদলের অভিজ্ঞ গণনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গণনাকেন্দ্রের ভিতরের অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ছলচাতুরি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মোকাবিলা করতে পারেনি। শাসকদলের সেই অভিজ্ঞ গণনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ‘ডামি’ প্রার্থীদের কাউন্টিং এজেন্ট হিসেবে যে বিপুলসংখ্যক দুষ্কৃতী ভিতরে ঢুকেছিল, তাদের সামলাতে পারেনি। শুধু ওরা কেন, আমি নিজেও বাইরের অভব্যতা দেখে শুধু স্তম্ভিত নয় একপ্রকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম! স্রেফ তিন রাউন্ডের গণনার পরে আমার পোস্ট করা যে ভিডিয়ো এই লেখার সঙ্গে দিলাম, সেটাই প্রমাণ।তবে শুধু টালিগঞ্জ নয়, পুরো বাংলা জুড়ে বেশিরভাগ গণনাকেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটেছিল!
‘নানা কারণে’ টালিগঞ্জ অরূপ বিশ্বাসের শক্ত ঘাঁটি। আর আমি তো বস্কে (মাননীয় শ্রী অমিত শাহ) বলেইছিলাম, আমাকে যদি প্রার্থী করেনই, তাহলে কোনও কঠিন কেন্দ্রেই করবেন। হোমগ্রাউন্ড আসানসোলে লড়লে দলের কোনও উপকার হবে না! যাক সে কথা। আসল কথা হল, বিজেপি-র ভুল ধরাতে এখন সকলে ব্যস্ত। সেটাই স্বাভাবিক। আর এটাও সত্যি যে সাকসেস হ্যাজ মেনি ফাদার্স, ফেলিয়োর হ্যাজ নান। সাফল্যের অনেক পিতা থাকে। ব্যর্থতার পিতৃত্ব কেউই স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু বিজেপি যখন ৭০-এর উপর আসনে জিতল, যখন কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট শূন্য, তখন সবটাই ভুল ছিল, এটা বলা কখনওই সমীচীন নয়।
সব খেলাতেই হারজিত আছে। টালিগঞ্জে তিন-চার হাজার ভোটে হারলে আমি তা মেনেও নিতাম। কারণ এটা সত্য যে, এলাকায় অরূপ বিশ্বাস বহু ছেলেকে বহু উপায়ে ‘রোজগারের রাস্তা’ দেখিয়েছেন। তাদের বিকল্প কোনও আয়ের সংস্থান করেননি। ১৫ বছর বিধায়ক থেকে আর তার মধ্যে ১০ বছর অসীম ক্ষমতাশালী মন্ত্রী থেকেও না। টালিগঞ্জ কেন্দ্রের সর্ব স্তরে চূড়ান্ত অবহেলার দৃশ্য, আবর্জনায় ঠাসা, বছরের পর বছর সংস্কার না-হওয়া মিশকালো দুর্গন্ধে ভরা খালের ধারে চরম কষ্টে যে অগুনতি বস্তিতে হাজারো মানুষ থাকেন। তাঁদের মধ্যেও কার এত হিম্মত আছে যে পাড়ায় পাড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন? পাড়ার পর পাড়ায় পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। নেই নিকাশি ব্যবস্থা। তবে যে যা-ই বলুক, যেমন সুচারু ভাবে গণনাকেন্দ্রের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ কাজে পরিণত করা হয়েছিল, তা দেখে চমকৃত তো হতেই হয়। কিন্তু ৫০,০০০ ভোটে আমায় হারানোটা হাস্যকর! অসাধু চতুর ভৃত্যও কিন্তু একটা সীমা রাখে, যাতে মালিকের মানিব্যাগ থেকে কত টাকা অবধি বার করে নিলে কারও সন্দেহ হবে না। অনেকে আদালতে পুনর্গনণার আবেদন করতে বললেও আমি তাতে আর যাইনি। কী লাভ আদালতের সময় নষ্ট করে? গণনাকেন্দ্রের ঘটনা তো নিজের চোখেই দেখেছি। চূড়ান্ত হতাশ আর বীতশ্রদ্ধ হয়েছি। শুধু শুধু ব্যাপারটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও তাগিদ আর অনুভব করিনি।
অরূপ বিশ্বাস ২০১৪ আর ২০১৯—দু’বারই আসানসোলে আমায় হারানোর দায়িত্বে ছিলেন। নানা রকম ‘আন্তরিক চেষ্টা’ করেছিলেন এবং করিয়েছিলেন। বেশ কিছু এলাকায় এবং বুথে সে লক্ষ্যে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বার ৭০,০০০ আর ২০১৯ সালে দু’লক্ষ ভোটে ওঁদের হারিয়েছিলাম। দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে, আসানসোলের মানুষের ভালোবাসায় জিতেছিলাম। গুন্ডা পুষে, বুথ দখল বা লুঠ করে বা মাঝরাতে বাড়ি বাড়ি থান কাপড় পাঠিয়ে জিতিনি। তবে এটা মানতেই হচ্ছে যে, আগামী দিনে ভোটে জিততে গেলে কী কী করতে হবে, তা নিজের চোখ দেখেছি গত ২ মে। এখন সরকার দুয়ারে-দুয়ারে, ক্লাবে-ক্লাবে মানুষের হাতে সরকারি টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। মানুষও খুশি মনে নিচ্ছে| না নেওয়ার পেছনে কোনও কারণও তো নেই! সরকারি টাকা তো মানুষেরই টাকা। কেনই বা নেবেন না? আমি যে তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারতাম না, তা নয়। কিন্তু আমি তা করতে পারিনি। কারণ করব বলে কখনও ভাবিইনি। তবে কোনও আফসোস নেই। জীবনে কিছু কিছু ব্যাপারে অসাফল্যও একপ্রকার বড় সাফল্য। তাই সেই সাফল্যকে পাথেয় করে, হাতজোড় করে, কিন্তু মাথা উঁচু করে সরে যাওয়াটাই ভাল মনে করেছি। বিশেষত, মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিতে বলায় এটাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ভোটের আগে বেশ কিছু ব্যাপারে আমার যে ঘোরতর আপত্তিগুলি ছিল এবং প্রকাশ্যেই ছিল, তাতে দল নিশ্চয়ই মনে করেছে বাংলার রাজনীতির জন্য আমি ‘লম্বি রেস কি ঘোড়া’ নই এবং আমার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপারে আদর্শ নিয়ে সঙ্ঘাত দলের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠছে, উঠবে। হয়ত সেটাই ঠিক। আর তাই ‘যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে’। একটা গান ছিল না, ‘কৌই বাত নহি’। গানই রইল আমার সাথী। সঙ্গে আপনারাও রইলেন। দু’বছরের বেশি আসানসোলের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগও রইল।এই ‘কম্বো’ তো যথেষ্ট ভাল। সঙ্গে আছে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করার উত্তেজনা।
ছোট থেকে গান রেওয়াজ করার সময় ‘আরোহন-অবরোহন’ অভ্যাস করতাম। অনুভবও করতাম আস্তে আস্তে গায়কিতে কী উন্নতি হচ্ছে| কিন্তু জীবনের যে ক্ষেত্রে সেই আরোহন-অবরোহনের নিয়মটাই বোধগম্য হল না, সেই ক্ষেত্রটায় আর হাত-পা ছোড়ার কোনও মানে হয় না| অনেক ধর্মের নানা রকম বই একটু-আধটু পড়েছি। সেখান থেকে একটি উক্তি নিজের সঙ্গে আগেই ‘শেয়ার’ করেছি। এখন আপনাদের সঙ্গেও করছি— ‘লা তাসাবুদ্দারা। উউ ওয়াল্লাহু’| বাংলায় এই আরবি লাইনটির সঠিক উচ্চারণ করা বা বানান লেখা মুশকিল। কিন্তু এর সারমর্ম ‘সময়ই হল ঈশ্বর। সময় নষ্ট কোর না’। সময়ের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা অস্বীকার করার তো সত্যিই কোনও উপায় নেই।
টালিগঞ্জ নিয়ে নেটগরিকদের অনেকেই অনেককিছু লেখেন। তাঁদের এটুকুই বলব যে, টালিগঞ্জের মানুষের উপর আমার কোনও অভিমান নেই। টালিগঞ্জে যা যা দেখেছি, অনুভব করেছি, সেগুলি সম্পর্কে না লিখলে, না বললে অরূপবাবুর ‘উল্লা’রা যে ‘উল্লাস’ করছে, দিনকে দিন তা আরও বাড়বে। এটা সত্যি যে, ওদের আটকানোর কোনও উপায় আমারও জানা নেই। তারা সঠিক মানুষের আশীর্বাদধন্য। যে কৌশলেই হোক না কেন, জিত তো ওদেরই হয়েছে। তবে আমার লেখা পড়ে কোথাও যদি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষও তাঁদের রাস্তা বদলান, মানুষের টাকায় মানুষের কিছু কাজও অন্তত করেন, তা হলে ক্ষতি কী? তবে ওখানকার মানুষ বা ফিল্ম জগতের কলাকুশলীরা অরূপবাবুর জয়ে খুশি হয়েছেন কি না, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আশা এটাই করব যে, ১৫ বছরের লম্বা ইনিংসে যে কাজগুলি টালিগঞ্জের মানুষের জন্য তিনবারের বিধায়ক, মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত কাছের মানুষ এবং প্রবল ক্ষমতাশালী মন্ত্রী অরূপবাবুর করা উচিত ছিল, আগামী পাঁচ বছরে উনি তার কয়েকটি অন্তত করবেন। এটুকুই। নাথিং মোর, নাথিং লেস। তাই কিছু পরিষ্কার কথা পরিষ্কার করে লিখলাম। দয়া করে এতে রাজনীতি খুঁজবেন না। আমি রাজনীতির মানুষ আর নই। যা করব, সে গানই হোক বা লেখা হোক বা কোনও কিছুর প্রতিবাদ বা সমর্থন, শুধুমাত্র আপনাদের জন্যই করব।
সব শেষে একটা কথা না বললেই নয়। রাজ্যে আবার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আসনে নির্বাচন হতে চলেছে| সেগুলিতে গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্র জয়লাভ করুক, মানুষ যা চায়, তার প্রকৃত প্রতিফলন হোক— এমনই আশা করব। জয়ের মধ্যে মানুষ যেন কোনও কলঙ্কের দাগ না দেখে, সেটা নিশ্চিত করা শাসকদলের কর্তব্য। জেতার উল্লাসে মেতে কেউ যেন এটা কখনও ভুলে না যায় যে, রাজনৈতিক রং যা-ই হোক, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই। রাজনীতি হোক আর জমিয়ে হোক। কিন্তু রাজনৈতিক হানাহানিতে মেতে, রক্তে ভিজিয়ে বাঙালির যে গৌরবময় ঐতিহ্যকে ভুলুন্ঠিত করা হয়েছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হোক। সরকার রাজধর্ম পালন করলে তবেই তা সম্ভব হবে। আগামিদিনে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃত ‘পরিবর্তন’ হবে, এটাই আমার-আপনার আর আপামর বাঙালির একান্ত ইচ্ছা।
সেই ইতিবাচকতা নিয়েই বলছি, আজ (তবে) এইটুকুই থাক…। সকলকে অনেক শুভেচ্ছা ও আন্তরিক ভালোবাসা। আর টালিগঞ্জের জন্য একটু বাড়তি শুভেচ্ছা। আপনাদের হয়ে লড়ে দারুণ লেগেছিল। ভাল থাকবেন আপনারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy