দুর্গাপুরের মাধাইগঞ্জের নেকড়ে। ছবি: মণীশ চট্টোপাধ্য়ায়।
আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় থাকা ভারতীয় ধূসর নেকড়েদের আবাসভূমি হিসাবে ইতিমধ্যেই পূর্ব ভারতে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের শিল্পশহর দুর্গাপুরের অদূরের লাউদোহা-ঝাঝরা বনাঞ্চল। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ (ডব্লিউডব্লিউএফ)-এর সহযোগিতায় ধারাবাহিক ভাবে তাদের সংরক্ষণের কাজ করছে পশ্চিম বর্ধমান বনবিভাগ এবং বন্যপ্রেমী সংগঠন উইংস (ওয়াইল্ডলাইফ ইনফরমেশন অ্যান্ড নেচার গাইড সোসাইটি)। রয়েছেন ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ (জেডএসআই)-এর বিজ্ঞানীরাও। অস্তিত্বের প্রান্তসীমায় চলে যাওয়া বাংলার নেকড়েদের রক্ষায় সচেতনতা গড়ে তুলতে এ বার এগিয়ে এল শহরও। ওয়াইল্ড আর্থ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজ্য বন দফতর, পঞ্চায়েত দফতর, জেডএসআই এবং ডব্লিউডব্লিউএফের আধিকারিকদের নিয়ে আয়োজিত হল এক কর্মশালা। সহযোগিতায় রোটারি ক্লাব অফ কলকাতা বেনেভোলেন্স এবং উইংস।
রাজ্যের অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল উজ্জ্বল ঘোষ, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের যুগ্মসচিব পীযূষ গোস্বামী, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের যুগ্মসচিব সন্দীপ দত্ত, প্রাক্তন বনকর্তা কল্যাণ দাস, বনপাল সুরত্ন শেরপা, জেডএসআইয়ের বিজ্ঞানী কৌশিক দেউটি, ডব্লিউডব্লিউএফের রাজ্যশাখার প্রধান শাশ্বতী সেন এবং ওয়াইল্ড আর্থ ফাউন্ডেশনের চন্দন গুপ্ত ছিলেন নেকড়ে সংরক্ষণ নিয়ে আয়োজিত ওই কর্মশালায়। ছিলেন, পশ্চিম বর্ধমানে নেকড়ে-সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি সংক্রান্ত সমীক্ষা এবং সংরক্ষণ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত সাগর অধূর্য, অর্কজ্যোতি মুখোপাধ্যায় এবং দীপ্তেশ গোস্বামী। তাঁরা জানালেন, কয়েক দশক আগেও রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল ওদের বসবাস। কিন্তু মানুষের সঙ্গে সংঘাত আর বসতি ধ্বংসের জেরে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ওরা। বিচরণক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছ’টি জেলার ছোট ছোট কয়েকটি অঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় থাকা সেই বিপন্ন ভারতীয় ধূসর নেকড়েদের পশ্চিম বর্ধমান জেলায় সংরক্ষণের জন্য শুরু হয়েছে একটি প্রকল্প। সৌজন্যে, দেশের প্রথম সারির বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থা ডব্লিউডব্লিউএফ-ইন্ডিয়া এবং ‘উইংস’। ১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ধূসর নেকড়ে ১ নম্বর তফসিল অর্থাৎ সর্বোচ্চ গুরুত্বে সংরক্ষিত প্রজাতি। পশ্চিম বর্ধমান জেলার শিল্পনগরী দুর্গাপুরের কাছাকাছি সম্প্রতি শুরু হয়েছে সেই নেকড়েদের সংখ্যা, বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস-সহ বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার কাজ। সেই সঙ্গে খোঁজা হচ্ছে, সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরে এবং মানুষের বসতির কাছাকাছি এলাকায় বসবাসকারী এই মাংসাশী প্রাণীগুলির সংরক্ষণের দিশানির্দেশও।
গবেষক অর্কজ্যোতি এবং সাগরের নেতৃত্বে প্রকল্পটি বেশ কয়েকটি মূল লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে—
১. নেকড়ের সংখ্যা নির্ধারণ: পশ্চিম বর্ধমানের ঘাসবনে মোট ক’টি ভারতীয় ধূসর নেকড়ে রয়েছে, তার আপেক্ষিক ছবি তুলে ধরা
২. পরিযানের পথ নির্ধারণ: নেকড়েদের যাতায়াতের ধরন বুঝতে তাদের সম্ভাব্য পরিযানের (মাইগ্রেশন) পথ ম্যাপিং করা।
৩. মানুষ-নেকড়ে সংঘাতের মোকাবিলা: যে সব এলাকা থেকে মানুষ-নেকড়ে সংঘাতের খবর আছে, সেগুলিকে চিহ্নিত করা এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।
৪. স্থানীয়দের মধ্যে সংবেদনশীলতা জাগানো: নেকড়েদের পরিবেশগত গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে এই গবেষণা মূলত নেকড়েদের আপেক্ষিক সংখ্যা মূল্যায়নের দিকে নজর করবে, তবে দলটি নেকড়েদের মলের নমুনা থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের জন্য তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পশ্চিম বর্ধমান জেলায় নেকড়ে জনসংখ্যার বর্তমান তথ্য অপ্রতুল। যদিও সংখ্যার প্রবণতা বিশ্লেষণ এই পর্যায়ে পরিচালনা করা যাবে না, এটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সমীক্ষক দলটি জেলায় পাঁচটি সুনির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করেছে যেখানে নেকড়ে দলগুলি বসবাস করে। প্রায় ১০টি ক্যামেরা ফাঁদ কৌশলগত ভাবে স্থাপন করা হবে যাতে ওই দলগুলির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাদের সদস্যদের সংখ্যা অনুমান করা যায় এবং তাদের অভিবাসনের পথ চিহ্নিত করা যায়। এই গবেষণাটি বন বিভাগের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এবং জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে মানুষ-নেকড়ে সংঘাত সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করবে। এ ছাড়াও, গ্রাম পর্যায়ের সচেতনতা শিবিরের মাধ্যমে নেকড়েদের পরিবেশগত ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে।
প্রায় একশো বছর আগে রাডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর মোগলি গল্পে লিখেছিলেন নেকড়ের পালের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা আট-দশ বছরের ছেলেটির কথা। মানুষখেকো বাঘ শের খানের থেকে মানবশিশু মোগলিকে রক্ষা করেছিল নেকড়েরা। এ বার কি সেই প্রতিদান ফিরিয়ে দেওয়ার পালা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy