Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Sandeshkhali Incident

‘পরিবর্তিত’ সন্দেশখালির মূল চরিত্র তিনিই! সেই গঙ্গাধর কয়ালের বাড়িতে আনন্দবাজার অনলাইন

১৩ দিন হল অনেক কিছু বদলেছে সন্দেশখালিতে। এক মাস আগে যেখানে গৃহবধূরা পথে নেমে মিছিল করছিলেন, নিত্য হাজির হচ্ছিলেন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা, সেই সন্দেশখালি শুক্রবার দুপুরে প্রায় জনহীন।

গ্রাফিক— সনৎ সিংহ

সারমিন বেগম
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ২১:৩৬
Share: Save:

তিনি দলকে ‘ডুবিয়ে দিয়েছেন’ না কি ‘কারুকুরি করা ভিডিয়োর শিকার হয়েছেন’ তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু সন্দেশখালির ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে (অনেকে যাকে সন্দেশখালি দ্বিতীয় পর্বও বলছেন) কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনিই। গঙ্গাধর কয়াল। যাঁকে লক্ষ্য করে তোলা স্টিং ভিডিয়োয় ‘সাজানো ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস’ হওয়ার পর থেকেই তিনি ‘অন্তরালে’ (ভিডিয়োর সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করে দেখেনি)। বিজেপির এই মণ্ডল সভাপতিই এখন সন্দেশখালি ঘিরে সব পক্ষের দাবি, পাল্টা দাবি বা কৌতূহলের কেন্দ্রে।

শুক্রবার কাঠফাটা দুপুরে সেই গঙ্গাধরের খোঁজেই পৌঁছনো গেল সন্দেশখালি। ফেরিঘাটে থেকে কয়ালপাড়া (গঙ্গাধরের পাড়া) ৬ কিলোমিটার দূর। তবে খুঁজে পেতে গুগল ম্যাপের দরকার পড়ল না। গন্তব্যের নাম বলতেই টোটোচালক পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘‘গঙ্গাধর কয়ালের বাড়ি যাবেন তো? রিপোর্টার?’’

১৩ দিন হল অনেক কিছু বদলেছে সন্দেশখালিতে। এক মাস আগেও যেখানে বাড়ির মহিলারা মিছিল করে পথে নেমেছিলেন, নিত্য যাতায়াত শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের, শুক্রবারের প্রখর দুপুরে সেই সন্দেশখালিই প্রায় জনহীন। আরও একটা বড় বদল— গঙ্গাধরকে এখন লোকে একডাকে চেনেন। টোটোওয়ালার কথায় আরও বুঝলাম, সন্দেশখালিতে এখন ‘কয়াল’ শব্দটুকুই যথেষ্ট গঙ্গাধরকে মনে পড়ার জন্য।

টোটোওয়ালা ঝটিতি হিসাব বলে দিলেন, ‘‘আপনি তো ফিরবেনও? যাওয়া আসা মিলিয়ে ২০০ টাকা! খানিক দরাদরি করে দেড়শোয় রফা করে শুরু হল যাত্রা। উৎসাহী টোটোওয়ালাই জানালেন, বাড়িতে গঙ্গাধরের স্ত্রী আছেন। তাঁকে তিনি চেনেনও। আর গঙ্গাধর? নাহ্, তাঁর ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।

বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়ি।

বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়ি। ছবি: প্রতিবেদক।

৪ মের পর থেকে গঙ্গাধর ‘নিখোঁজ’ পুলিশের খাতায়। সন্দেশখালির স্টিং ভিডিয়োয় ‘তাঁর বক্তব্য’ প্রকাশ্যে আসার পর থেকে তাঁকে আর সশরীরে দেখা যায়নি। শুধু দেখা গিয়েছে একটি ভিডিয়ো। যেখানে নিজের পরিচয় দিয়ে গঙ্গাধর বলছেন, স্টিং ভিডিয়োয় তাঁকে দেখা গেলেও তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। এর পরেই সন্দেশখালি থানায় গঙ্গোধরের নামে মামলা এবং তিনি বেপাত্তা।

সেই গঙ্গাধরের বাড়ির সামনেই পৌঁছনো গেল শুক্রবার দুপুর ৩টে নাগাদ। প্রায় ছ’কিলেমিটার উঁচুনিচু রাস্তা পেরিয়ে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে টোটোওয়ালা আর গঙ্গাধরের নামোচ্চারণ করলেন না। ইশারায় দেখিয়ে দিলেন বাড়ি। ইশারাতেই বোঝালেন, ‘ভিতরে লোক আছে, ডাকুন!’

বাঁশের বেড়া চৌহদ্দি দেওয়া বাড়িটা পাকা নয়। মাটির ভিত। অ্যাসবেসটসের চাল। দরমার দেওয়াল। বৃষ্টির জল থেকে বাঁচাতে মাটির উপর প্লাস্টিকের ত্রিপল মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই প্লাস্টিকে পা রেখে জানলায় মুখ বাড়িয়েই হাঁক দিলাম, ‘‘গঙ্গাধরবাবু বাড়িতে আছেন? কেউ আছেন বাড়িতে?’’

বেড়ার লাগোয়া গেটটিও বাঁশের। তবে তাতে লোহার শিকল। তালা ঝোলানো। ঢোকার উপায় নেই ভিতরে। হাঁকডাকের জন্য তাই জানলাই ভরসা। সেখান দিয়েই মুখ বাড়িয়ে এক ঝলক ভিতরে দেখা গেল।

অগোছালো ঘর গঙ্গাধরের।

অগোছালো ঘর গঙ্গাধরের। ছবি: প্রতিবেদক।

অগোছালো ঘর। তার উপর রাখা তক্তপোশ দেওয়ালের গায়ে একটি শোকেস। তাতে সারি সারি শাড়ি, জামাকাপড়। সম্ভবত জামাকাপড়ের ব্যবসা ছিল বিজেপির মণ্ডল সভাপতির। তক্তপোশের এক পাশা রাখা একটি টিনের বাক্স। সম্ভবত ক্যাশ বাক্স। সেটির রং সবুজ।

দেখে এখানে আসার পথে টোটোওয়ালার কাছে শোনা গল্প মনে পড়ছিল। ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সন্দেশখালির আন্দোলনের পর এখানে কী বদলেছে? বলছিলেন, ‘‘মুখ খোলা যাচ্ছে এখন। আগে যেত না।’’ কী রকম? প্রশ্ন করায় টোটোওয়ালা বললেন, একবার তাঁদেরই এক সহকর্মীকে টোটোয় কমলা (গেরুয়ার কাছাকাছি) রঙের তালা ঝোলানোর ‘অপরাধে’ সেই তালা বদলাতে বাধ্য করা হয়েছিল। এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। তবে পদ্মের মণ্ডল সভাপতির ঘরে দিব্যি শোভা পাচ্ছে সবুজ ক্যাশবাক্স।

আলো আঁধারিতে চোখ সয়ে যেতে চোখে পড়ছিল দরমার দেওয়াল আড়াল করতে ঝোলানো রঙিন কাপড়ের ‘শামিয়ানা’ও। মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই স্টিং ভিডিয়োর দৃশ্য। মিল আছে। তবে কি এই ঘরে বসেই সন্দেশখালির ‘পরিবর্তন’ রচনা করেছিলেন গঙ্গাধর? ভাবতে ভাবতে আবার ডাকলাম, ‘‘কেউ আছেন? আমার কাছে কিন্তু কোনও লুকোনো ক্যামেরা নেই। আমি এসেছি আপনাদের কথা শুনব বলে। আপনারা কিছু বলবেন না?’’

বোধ হয় একটু থমকাল বাড়ির ভিতরের নীরবতা। সাড়া এল। এক মহিলাকণ্ঠ বলে উঠলেন, ‘‘যা বলার সিবিআইকেই বলব।’’

জানলা দিয়ে তখন প্রাণপণ খুঁজছি কণ্ঠস্বরের অধিকারিনীকে। কিন্তু কাউকে দেখা তো দূরের কথা, ঘরের একটি কুটোও নড়তে দেখা যাচ্ছে না। আড়াল থেকেই ভেসে আসছে কথা। বললাম, ‘‘সামনে আসুন। আপনাদের কথা শুনতেই তো এসেছি।’’ জবাব এল, ‘‘সিবিআই দেখছে। সিবিআইকেই বলব।’’ তার পর আবার সেই নিস্তব্ধতা। হাজার ডাকাডাকিতেও যা ভাঙা গেল না।

বাড়ির দেওয়ালে পুলিশ সেঁটে গিয়েছে নোটিস।

বাড়ির দেওয়ালে পুলিশ সেঁটে গিয়েছে নোটিস। ছবি: প্রতিবেদক।

মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম টোটোওয়ালা তখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তাঁকে আর একটু দাঁড়াতে বলে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। বাঁশের বেড়ার চৌহদ্দির মধ্যে দরমার ঘরের পাশাপাশি রয়েছে খরের চালের ঘরও। আর একটি পাকা শৌচালয়। চেষ্টা করছিলাম, যদি শেষ পর্যন্ত কাউকে দেখা যায়! কিন্তু না, কোথাও কাউকে দেখা গেল না। কারও গলাও শোনা গেল না।

ফেরার পথে শুনছিলাম— সন্দেশখালির এই কয়ালপাড়া ‘সবুজ’ সীমার খানিক বাইরে। এখানে ধীরে ধীরে বিজেপির ক্ষমতা বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু গঙ্গাধরের নামে হাঁকডাক শুনেও তাঁর বাড়ি তো দূরের কথা, কাছাকাছির বাড়িঘর থেকেও কেউ বেরিয়ে এলেন না।

জানলার ধারে দরমার দেওয়ালেই সাঁটা ছিল পুলিশের সমনের নোটিস। যেখানে গঙ্গাধরকে ১১ মে সকাল ১১টার মধ্যে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছিল। তার পর থেকে ছ’দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গঙ্গাধর যাননি। যাবেন কি না তা-ও জানা যায়নি। আপাতত তাঁর পরিবারের এবং হয়তো তাঁরও ভরসা সিবিআই। এবং হাই কোর্ট। যে হাই কোর্ট পর পর দু’দিন গঙ্গাধরকে মৌখিক রক্ষাকবচ দিয়ে রেখেছে।

শুক্রবারই কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের বেঞ্চে উঠেছিল গঙ্গাধরের মামলা। তিনি ওই রক্ষাকবচ বহাল রেখে মামলাটি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। বলেন, ‘‘পরবর্তী শুনানি কবে হবে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানবিচারপতিই।’’

গঙ্গাধর-পর্ব এখন বিচারের অপেক্ষায়। ভোটের মাঝপথে যে 'বিপরীত ঝড়' তুলেছে 'তাঁর ভিডিয়ো', বিচারের অপেক্ষায় তা-ও। সত্য উদ্ঘাটিত হতে হতে হয়তো ভোট পেরিয়ে যাবে। সেই সত্য কী, এক গঙ্গাধর জানেন, আর জানেন কেউ কেউ। গঙ্গাধরের পরিবারও জানে কি? উত্তর ছাড়াই ফিরে আসতে হল সন্দেশখালি থেকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Gangadhar Koyal Sandeshkhali Incident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy