(বাঁ দিকে) অধুনা প্রয়াত দুই সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী এবং অমিতাভ নন্দী। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিম (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শাসক থাকলে বিরোধীও থাকে। বিরোধী পরিসর শূন্য থাকে না কখনও। কিন্তু বাংলায় তৃণমূল যখন একচ্ছত্র ক্ষমতায়, বিরোধীরা যখন খানিকটা ‘ছন্নছাড়া’ এবং জুতসই আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না, তখন দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের নেতারাই শাসক এবং বিরোধী— দুই ভূমিকাতেই অবতীর্ণ। কেউ পুলিশ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তার জবাবে কোনও নেতা আবার সেই নেতার ‘এক্তিয়ার’ নিয়ে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে শাসক তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা যে ‘বাক্ স্বাধীনতা’ দেখাচ্ছেন, তা দেখে মনে হচ্ছে, সিপিএম জমানার বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে তৃণমূল!
বিরোধীরা যখন সে ভাবে দাগ কাটতে পারছে না (অন্তত একের পর এক ভোটের ময়দানে), আরজি কর কাণ্ডে যখন প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক দলকে দূরে সরিয়ে দানা বেঁধেছে ‘নাগরিক আন্দোলন’, যখন আমজনতার একাত্ম স্লোগান হয়ে উঠেছে ‘বিচার চাই’, তখন দেখা যাচ্ছে শাসকদলের মধ্য থেকেই ‘বিরোধী স্বর’ উচ্চারিত হচ্ছে। যেমন সিপিএমের জমানাতেও দেখা গিয়েছিল। অনেকে ব্যাখ্যা করছেন, ‘নিষ্কণ্টক’ ক্ষমতাধারী হলে এমনই হয়। আবার অনেকে বলছেন, এ হল রাজনৈতিক পরিসরে ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকার তাড়না।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের দলই সকলের সুখ-দুঃখে রয়েছে। তাই সব অংশের মানুষের কণ্ঠস্বরও তৃণমূলের মধ্যেই প্রতিফলিত হচ্ছে।’’ অর্থাৎ, তৃণমূলই শাসক। তৃণমূলই বিরোধী। শাসকদলের এক রসিক নেতা অবশ্য এর মধ্যে কোনও গূঢ় রাজনৈতিক তত্ত্ব দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘এ তো ফ্রিস্টাইল সাঁতার কাটা! তৃণমূল ‘রেজিমেন্টেড’ দল নয়। তাই যে যার মতো বলছে। কারও উপরে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। কাউকে তিন বার, কাউকে চার বার টিভিতে দেখাচ্ছে। তাতেই আনন্দ! এ জিনিস আরও হবে। আরও বাড়বে।’’
পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসনকালের একটা বড় সময়ে দেখা গিয়েছিল, বিরোধীরা ‘ম্রিয়মান’। বরং সিপিএম নেতাদের নিজেদের মধ্যে গোলমাল প্রকাশ্যে চলে আসছে। উত্তর ২৪ পরগনা সিপিএমে অমিতাভ বসু বনাম অমিতাভ নন্দীর লড়াই ছিল সর্বজনবিদিত। জেলার রাজনীতিতে পৃথক ‘ভরকেন্দ্র’ হয়ে সুভাষ চক্রবর্তী যে কত বার পার্টিকে ‘বিড়ম্বিত’ করেছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। একান্ত আলোচনায় সিপিএমের এক ছাত্রনেতার বক্তব্য, ‘‘কল্যাণ-মদনের কথার যুদ্ধ দেখে আমার সুভাষদা-নন্দীদার (অমিতাভ) কথা মনে পড়ছিল।’’ হুগলি জেলার রাজনীতিতে অনিল বসু বনাম রূপচাঁদ পালের লড়াইয়ের কথা দলের ভিতরে-বাইরে সকলে জানতেন। আবার হাওড়ার রাজনীতিতে স্বদেশ চক্রবর্তী, দীপক দাশগুপ্তদের আকচাআকচি গড়িয়েছিল নীচের লোকাল কমিটি স্তর পর্যন্ত। অবিভক্ত মেদিনীপুরে দীপক সরকার, সুশান্ত ঘোষদের সঙ্গে সূর্যকান্ত মিশ্রের ‘মধুর’ সম্পর্ক ছিল বঙ্গ রাজনীতিতে পরিচিত বিষয়। সিপিএমের অনেকেই জানতেন, জেলার রাজনীতিতে দীপকদের ‘খোলা মাঠ’ দিতেই সূর্যকান্তকে মন্ত্রী এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে কলকাতায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
পাশাপাশিই, লড়াই ছিল বামফ্রন্টের মধ্যেও। সিপিএমের সঙ্গে বাম শরিকদের লড়াই শাসক-বিরোধী কিছু ক্ষেত্রে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে সিপিএমের সঙ্গে লড়াই ছিল আরএসপি-র। আবার কোচবিহারে সিপিএম ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের ‘শ্রেণিশত্রু’। তৃণমূলের ক্ষেত্রে তা নেই। কারণ, তৃণমূল এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম! তাদের কোনও ফ্রন্ট বা জোট নেই। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্যের ক্ষমতায় এলেও সেই ‘সখ্য’ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফলে এই আমলে শরিকি সংঘাতের সুযোগ নেই। তার বদলে জেলায় জেলায় সংঘাত রয়েছে তৃণমূলের সঙ্গে তৃণমূলেরই। যেমন বাম জমানায় ছিল সিপিএমে।
কসবায় তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল গত শুক্রবার। তার পরে গত এক সপ্তাহে ওই ঘটনা নিয়ে ফিরহাদ হাকিম, সৌগত রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা যে ভাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন, তা নিয়ে ‘আলোড়িত’ শাসকদল। যাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন মদন মিত্র এবং হুমায়ুন কবীর। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীরা শাসক শিবিরের মধ্যে সেই ‘কথার লড়াই’ নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য ছাপিয়ে গিয়েছে ফিরহাদ-কল্যাণদের নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি।
সিপিএম জমানায় টেলিভিশন বা ইউটিউবের এই রমরমা ছিল না। কিন্তু তাতেও মমতা, সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের বক্তব্য চাপা পড়ে যেত সিপিএম নেতাদের ‘দ্বন্দ্ব’মূলক বস্তুবাদের আড়ালে। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও সিপিএমের নেতাদের মধ্যে লড়াইয়ের নজির ছিল। দমদমে জোড়া খুনের ঘটনায় কাশীপুর-বেলগাছিয়া এলাকার সিপিএম নেতা দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ। কিন্তু পুলিশ যখন দুলালকে দমদমের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করতে যায়, তখন রাস্তায় শুয়ে পড়ে পুলিশের গাড়ি আটকাতে গিয়েছিলেন সিপিএমেরই নেতা রাজদেও গোয়ালা। সফল হননি। এক যুগের বেশি সময় দুলালকে জেল খাটতে হয়েছে দোষী সাব্যস্ত হয়ে।
সিপিএমের তরুণ নেতা সায়নদীপ মিত্র আবার প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁদের আমলের সঙ্গে তৃণমূলের জমানাকে এক করে দেখতে চাননি। তাঁর ব্যাখ্যা, সিপিএম জমানায় নেতাদের দ্বন্দ্ব ছিল ‘মতাদর্শগত’ প্রশ্নে। পাশাপাশি বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের নেতারা মমতাকে বার্তা দিচ্ছেন। আরজি কর-কাণ্ডের সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে মুখ খুলে শান্তনু সেন বুঝিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি ব্যর্থ। আবার কসবা-কাণ্ডের পরে ফিরহাদ বা হুমায়ুনেরা বোঝাচ্ছেন, পুলিশমন্ত্রী মমতাও ব্যর্থ।’’ রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারিও অন্য দলের সঙ্গে তৃণমূলের তুলনা করতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘অন্য দলের সঙ্গে তৃণমূলের তুলনা করা যায় না। কারণ, অন্য সব দলে সংগঠন আর মতাদর্শ থাকে। তৃণমূলে সংগঠন এবং মতাদর্শের ভিত্তি হল টাকা এবং চুরি।’’
‘প্রান্তিক’ শক্তিতে পরিণত হওয়া সিপিএম তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ‘বোঝাপড়া’র কথা নিয়ম করেই বলে যাচ্ছে। আবার বিজেপির বক্তব্য, দিল্লিতে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’য় সিপিএম-তৃণমূল ভাই-ভাই। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতা আসলে নাটক। তবে ধারাবাহিক ঘটনাক্রম বলছে, রাজ্যে তৃণমূলকে বিপাকে ফেলার মতো বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। আরজি কর পর্বে সরকার-বিরোধী যে স্বরের গর্জন শোনা গিয়েছিল, তা-ও ছিল দল এবং ঝান্ডাহীন। সেখানে চেষ্টা করেও রং লাগাতে পারেনি সিপিএম বা বিজেপি। আরজি কর নিয়ে সেই আন্দোলনের ঝাঁজ যখন একেবারেই কমে এসেছে, তখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীর খুব প্রয়োজন নেই। তৃণমূলের বিরোধী সেই তৃণমূলই। যেমন হত বাম আমলে— সিপিএম বনাম সিপিএম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy