Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ব্রাত্য থেকেই প্রয়াত আর্সেনিক পীড়িতদের অভিভাবক

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া থানা এলাকার জনা পাঁচেক বাসিন্দা এসে কেঁদে পড়েছেন তাঁর কাছে। গায়ে কালো কালো দাগ। আঙুলের গোড়া থেকে ঘা। আঙুল খসে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। গ্রামের মানুষ তাঁদের কুষ্ঠ রোগী বলে একঘরে করে দিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন কুষ্ঠ নয়।

এক রোগীর সঙ্গে কে সি সাহা। ফাইল চিত্র

এক রোগীর সঙ্গে কে সি সাহা। ফাইল চিত্র

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৬ ০৩:০৯
Share: Save:

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া থানা এলাকার জনা পাঁচেক বাসিন্দা এসে কেঁদে পড়েছেন তাঁর কাছে। গায়ে কালো কালো দাগ। আঙুলের গোড়া থেকে ঘা। আঙুল খসে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। গ্রামের মানুষ তাঁদের কুষ্ঠ রোগী বলে একঘরে করে দিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন কুষ্ঠ নয়। এক কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে আক্রান্তেরা এসেছেন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ত্বক বিভাগে। বিভাগীয় প্রধান ক্ষিতীশ সাহার কাছে ওই সব রোগীর কাতর আবেদন, ‘আপনি আমাদের বাঁচান।’

আক্রান্তদের গায়ের দাগ দেখে আর ক্ষয়ে যাওয়া আঙুল পরীক্ষা করে ক্ষিতীশবাবু বুঝেছিলেন ওটা কুষ্ঠ নয়। কিন্তু কী, তা বুঝতে পারলেও পরীক্ষা না করে নিশ্চিত ভাবে বলতে চাননি তিনি। আক্রান্তদের চুল, নখ আর মুত্রের নমুনা নিয়ে নিজের গবেষণাগারের দরজা বন্ধ করলেন ত্বক বিভাগের প্রধান।
দেখা গেল তিনি যেমন ভেবেছেন, ঠিক সেটাই হয়েছে। কুষ্ঠ নয়। হাবড়া থানা এলাকার বাসিন্দারা আর্সেনিক দূষণের শিকার। সেটা ১৯৮২ সালের কথা।

রোগ তো ধরা প়ড়ল। কিন্তু কোথা থেকে ছড়াচ্ছে রোগটা? নিজের দলবল আর গবেষক নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন ত্বক বিভাগের প্রধান। দুই বছর পরে রহস্যের সমাধান হল। ক্ষিতীশবাবু ১৯৮৪ সালে রাজ্য সরকারকে লিখলেন, ‘নলকূপের জল থেকে ছড়াচ্ছে আর্সেনিক দূষণ।’ নলকূপে সেই বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক কোথা থেকে এল, তা ধরা পড়ল কিছু দিনের মধ্যে। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন জানাল, ভূগর্ভ থেকেই উঠে আসছে ওই কালান্তক রাসায়নিক। তার পর থেকে শুরু হল লড়াই। তিনি স্বাস্থ্য দফতরের অধীনে কাজ করতেন। এত বড় একটা কাজের স্বীকৃতি কিন্তু তাঁকে সে সময় রাজ্য দেয়নি। কিন্তু বিভিন্ন জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশ বন্ধ করতে পারেনি সরকার! আর সেই সব নিবন্ধের জেরেই সারা বিশ্ব জেনে গেল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের মাটির তলায় কী সর্বনাশ অপেক্ষা করছে।

উত্তর ২৪ পরগনার একটি গ্রামের মানুষের চামড়ায় কিছু লক্ষণ দেখে আর্সেনিক দূষণের বিষয়টি সর্বসমক্ষে এনেছিলেন ওই চিকিৎসক। ১৯৮৬ সালের মধ্যে দেখা গেল, শুধু হাবড়া থানা এলাকাই নয়, উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা, স্বরূপনগর, বারাসত, মধ্যমগ্রাম, বসিরহাট, ব্যারাকপুর, আমডাঙা, বনগাঁ, গাইঘাটা, রাজারহাট সব জায়গা থেকে একই ধরনের লক্ষণযুক্ত রোগীরা আসছেন ট্রপিক্যালে। রোগের কথা ছড়িয়ে পড়তেই আরও বেশি সংখ্যায় রোগী আসতে লাগল মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়া থেকে। আর ততদিনে ভূ-বিজ্ঞানীরা নেমে পড়েছেন ভূ-স্তরে কী ভাবে আর্সেনিক এমন মাত্রায় এল তার রহস্য সন্ধানে। ১৯৮৮ সালের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল গঙ্গার পূর্বপাড় বরাবর রাজ্যের সব ক’টি জেলাই আর্সেনিক-প্রবণ। আর জানা গেল গায়ের ওই দাগ আর ক্ষতের জন্য ওই জেলাগুলিতে কত সংসার ভেঙে গিয়েছে। কত পরিবার শেষ হয়ে গিয়েছে ত্বকের ক্যানসারে। সেই সময় চিকিৎসকেরা কিন্তু মৃত্যুর কারণ হিসেবে আর্সেনিক দূষণ লিখতেন না। নিষেধাজ্ঞা ছিল।

রাজ্য সরকারের তাঁর আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেওয়া বা না-দেওয়ার বিষয়টি গায়েই মাখেননি ক্ষিতীশবাবু। তিনি বলতেন, ‘ওই মানুষগুলিকে বাঁচাতে হবে। ওষুধে যে কাজ হবে না সেটা লোককে জানাতে হবে। আর্সেনিকমুক্ত জল দিতে হবে ঘরে ঘরে। আর বলতে হবে, আর্সেনিক সংক্রামক নয়। ছোঁয়া লাগলে, রক্তের সংস্পর্শে তা ছড়ায় না। বাঁচাতে হবে পরিবারগুলিকে।’ কিন্তু সরকার তো আর তা প্রচার করবে না, তাই ক্ষিতীশবাবু নিজেই নেমে পড়লেন মাঠে। এক দিকে মানুষকে বিকল্প জল খাওয়ার পরামর্শ, অন্য দিকে গায়ের দাগ কুষ্ঠ নয় বলে প্রচার শুরু করলেন ওই চিকিৎসক। নিজেই লিখে ফেললেন পথনাটিকা। কিন্তু সেই নাটক মঞ্চস্থ করবে কে? আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি নামে একটি সংগঠনকে পাশে
পেয়ে গেলেন ওই ‘পাগল’ ডাক্তার। বেশ কয়েকটি পরিবার ভেঙে যেতে যেতে বেঁচে গেল।

এর মধ্যেই ৯০ দশকের প্রথমে বাংলাদেশে ধরা পড়ল বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), বিশ্ব ব্যাঙ্ক এগিয়ে এল সাহায্যের ঝুলি নিয়ে। রাজ্য সরকারের টনক নড়ল। তৈরি হল আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স। কিন্তু ক্ষিতীশ সাহার তাতে স্থান হল না। তাঁর নির্দেশিত পথেই তৈরি হল যাবতীয় পরিকল্পনা। ব্রাত্যই থেকে গেলেন ক্ষিতীশ সাহা। এতে অবশ্য কোনও আক্ষেপ ছিল না আর্সেনিক দূষণের আবিষ্কারকের। যে ডাকত সেখানেই আর্সেনিক দূষণ নিয়ে বলতে দৌড়তেন তিনি। কাগজে খস খস করে নিজের বক্তব্য লিখে দিতেন। দুই লাইন লেখার অনুরোধ থাকলে একপাতা লিখে দিতেন। বলতেন, ‘মানুষ যত বেশি করে জানবে, ততই সতর্ক হবে। তত বেশি করে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের জন্য দাবি তুলবেন মানুষ।’ ‘এতদিন হয়ে গেল তবু সব জায়গায় আর্সেনিক মুক্ত জল গেল না। মানুষগুলি মরে গেল’- এই সেদিনও আক্ষেপ করছিলেন তিনি।

মাস তিনেক আগে আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক অশোক দাসকে সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ক্ষিতীশবাবু। ৮৬ বছরের মানুষটি তখন রীতিমতো অশক্ত। অশোককে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন সে দিনই, ‘আমি এখন আর পারছি না। তোমরা কিন্তু থেমে থেকো না। আর্সেনিক-পীড়িত সব মানুষের কাছে আর্সেনিকমুক্ত জল পৌঁছে দিতেই হবে।’

শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই শুক্রবার ৩ জুন সকালে সল্টলেকের বাসভবনে মারা গেলেন ‘পাগল’ ডাক্তার। চলে গেলেন আর্সেনিক পীড়িত মানুষগুলির অভিভাবক।

অন্য বিষয়গুলি:

Arsenic Water Disease Doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy