Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Arsenic

পাইপ ফুটো করে জল পাওয়াই কি ভবিতব্য

সরকার আছে। আইন আছে। তবু কেউ নেই প্রকৃতি, পরিবেশের। মানুষের। বিষ জল, স্থল, বাতাসে।রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দাবি, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলিতে জল পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি প্রকল্পের পাইপলাইন থেকে এ ভাবেই জল বার করেন কল্যাণপুর গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। নিজস্ব চিত্র

জনস্বাস্থ্য কারিগরি প্রকল্পের পাইপলাইন থেকে এ ভাবেই জল বার করেন কল্যাণপুর গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। নিজস্ব চিত্র

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:৩০
Share: Save:

কোন জল খান আপনারা?

জবাব দেওয়ার আগে, মাসুদ শেখ, মসফর শেখের মতো বর্ধমানের কল্যাণপুরের কয়েকজন বাসিন্দা নিয়ে যান গ্রামে ঢোকার মুখে একটি রাস্তার কাছে। সেখানে রাখা কংক্রিটের একটি চাঁই শাবল দিয়ে তুলে দেখান, মোটা পাইপের গা ফুটো করে লাগানো হয়েছে সরু পাইপ। তা থেকে বেরোচ্ছে জল।

এ জল কি পরিস্রুত? মসফর, মাসুদেরা বলেন, ‘‘জানি না। ভাগীরথী থেকে তোলা এ জল রিজ়ার্ভারে যায়। এতে আর্সেনিক নেই বলে শুনেছি। সেটাই বাঁচোয়া।’’ বাসিন্দাদের দাবি, গ্রামে সরকারি নলকূপ নেই। কোনও কারণে প্রকল্পের জল বন্ধ থাকলে, তাঁদের জল নিতে হয় ব্যক্তিগত নলকূপ থেকে। তাতে আর্সেনিক রয়েছে, তা জেনেও। কল্যাণপুরে পাইপ ফুটো করার বিষয়টি তাঁরা জানেন না বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের স্থানীয় কর্তারা। তবে তাঁদের দাবি, ওই পাইপে যে জল যায়, তা পরিস্রুত।

রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দাবি, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলিতে জল পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে। তার ফলে, নানা জেলায় আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। পানীয় জলে আর্সেনিক-সহ ক্ষতিকারক কোনও ধাতু মিশে রয়েছে কি না, তা জানার জন্য পূর্ব বর্ধমান জেলায় রয়েছে ১৪টি পরীক্ষাগার। জল পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্মী-আধিকারিকদের অনেকেরই দাবি, আগে মাটির নীচে যে স্তরে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক মিলত, এখন বহু এলাকায় নলকূপ বসানো হয় সে স্তর পার করে। সেই সঙ্গে গত দেড় দশকে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের বহু প্রকল্প গড়ে ওঠায় আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে।

পূর্ব বর্ধমানের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সোমনাথ কুণ্ডুর দাবি, ‘‘পূর্বস্থলীর কল্যাণপুর ছাড়া, আপাতত জেলার অন্য কোথাও আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগী নেই। নানা এলাকায় আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল বাড়ি-বাড়ি দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’’ মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলিতে আর্সেনিক-যুক্ত পানীয় জলের উৎসগুলি চিহ্নিত করে সেখানকার জল ব্যবহার না করার জন্য সচেতনতার কাজ চলছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য কারিগরি কর্তারা। মালদহ-সহ অন্য জেলাতেও বেশ কিছু জলপ্রকল্প তৈরি করা হয়েছে বলে তাঁদের দাবি।

‘আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি’র যদিও দাবি, রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রকল্পের মাধ্যমে পরিস্রুত করার সময়ে তা পুরোপুরি আর্সেনিক-মুক্ত করা যাচ্ছে না। ভূপৃষ্ঠের জল ব্যবহারই রেহাইয়ের একমাত্র উপায় বলে মনে করছে তারা। কিন্তু সে জল ব্যবহারে কোনও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না, দাবি কমিটির।

আর্সেনিকের বিপদ কেটে গিয়েছে বলে মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞেরাও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক তথা গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী জানান, মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতার মতো ভাগীরথীর পূর্ব দিকের জেলাগুলিতে আর্সেনিকের প্রকোপ বেশি। তালিকায় রয়েছে পূর্ব বর্ধমানও। তাঁর কথায়, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় কোনও নলকূপের জলে এখন না পাওয়া গেলেও, পরে আর্সেনিক পাওয়া যেতে পারে। সময়ের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী স্তর থেকে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ওই নলকূপের জলে মিশতে পারে।’’ তড়িৎবাবুর মতে, আর্সেনিকের হাত থেকে রেহাই পেতে মাটির তলার জল চাষের কাজে লাগানো বন্ধ করা প্রয়োজন। কৃষিজ পণ্যের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক বহু মানুষের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে। বিকল্প হিসেবে মাটির উপরের অংশের জল ব্যবহারেই বেশি জোর দিতে হবে, জানাচ্ছেন তিনিও।

বছরখানেকের মধ্যে আর্সেনিকোসিসে পর পর বাবা-মা-কে হারিয়েছেন কল্যাণপুরের বাসিন্দা মাজিরা পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের রহিম মল্লিক। তাঁর খেদ, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতায় আমাদের সরকার। এই গ্রামের কথা ভেবেই এলাকায় হয়েছে পরিস্রুত জলের প্রকল্প। কিন্তু সে জল আমরা পাই না। পাইপ ফুটো করে পাওয়া জলই যেন ভবিতব্য আমাদের।’’

(তথ্য সহায়তা: সীমান্ত মৈত্র, সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও অভিজিৎ সাহা)

অন্য বিষয়গুলি:

Arsenic Drinking Water
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy