রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
দীর্ঘ ১০ মাস পর, সোমবার তাঁকে সশরীরে হাজির করানো হয়েছিল আদালতে। আদালতে উপস্থিত হয়ে তিনি যা বললেন, তা আগে কখনও বলেননি নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। আদালতে ঢোকার সময় মুখে কুলুপ আঁটলেও এজলাসে তাঁর আইনজীবী দাবি করলেন, ‘মাস্টারমাইন্ড’ আসলে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অর্পিতা কেবলই পরিস্থিতির শিকার। অর্পিতার হয়ে সওয়াল করতে দিল্লি থেকে এসেছেন দুঁদে আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। যিনি ঘণ্টাখানেকের শুনানিতে বার বার দাবি করলেন, তাঁর মক্কেল কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন না। সবটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন আসলে পার্থ।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অবশ্য এ সব দাবি মানেনি। তাদের পাল্টা দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে অর্পিতারও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পার্থ যদি ‘রাজা’ হন, তা হলে অর্পিতা ‘ডিফ্যাক্টো রানি’ (প্রকৃতপক্ষে রানি)। পার্থ এবং অর্পিতার সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তারা। তাদের প্রশ্ন, অর্পিতা যদি কিছুই না জানতেন, তা হলে নিজের ফ্ল্যাটে টাকা, গয়না রাখতে দিয়েছিলেন কেন? অর্পিতার ‘প্রভাব’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ইডি। কেন্দ্রীয় ওই তদন্তকারী সংস্থার মতে, এখনও অর্পিতার এতটাই ‘ক্ষমতা’ যে, নিজের আইনজীবীর জন্য যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারি প্ল্যাকার্ড রয়েছে।
১০ মাস পর
গত জুলাই মাসে ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অর্পিতা। তার পর থেকে আলিপুর মহিলা জেলেই রয়েছেন তিনি। গ্রেফতারির পর বেশ কয়েক বার তাঁকে আদালতে সশরীরে হাজির করানো হয়েছিল। গত অগস্টের শেষ থেকে তাঁকে আদালতে আর সশরীরে হাজির করানো হয়নি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানিতে অংশ নিচ্ছিলেন অর্পিতা। অবশেষে ১০ মাস পর, সোমবার ইডির বিশেষ আদালতে হাজির করানো হল তাঁকে। অর্পিতার জামিনের আবেদনের শুনানি ছিল। গ্রেফতারির পর অর্পিতার তরফে জামিন চাওয়া হলেও আর আবেদন করা হয়নি। তার পর দীর্ঘ ১০ মাসে এই প্রখম জামিনের আবেদন করা হল। সোমবার আদালতে দীর্ঘ ক্ষণ চলে সওয়াল-জবাব। রায় ঘোষণা বুধবার।
পার্থই ‘মাস্টারমাইন্ড’
অর্পিতার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ইডি তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করেছিল কোটি কোটি টাকা। সঙ্গে গয়না, মোবাইল ফোন। এত দিন অর্পিতা সুযোগ পেলেই সংবাদমাধ্যমের সামনে দাবি করছিলেন, তাঁকে ‘ফাঁসানো’ হচ্ছে। এই প্রথম অর্পিতার আইনজীবী আদালতে দাবি করলেন, তাঁর মক্কেল ‘পরিস্থিতির শিকার’। আদতে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ। যে সব সংস্থার সঙ্গে অর্পিতা জড়িত ছিলেন বলে ইডি দাবি করেছে, সেগুলিও আসলে নিয়ন্ত্রণ করতেন পার্থ এবং তাঁর পরিবার। ওই সংস্থা থেকে অর্পিতা লাভবানও হননি। সোমবার এজলাসে অর্পিতার আইনজীবী দাবি করেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই মিথ্যে। এমনকি, অর্পিতাকে গ্রেফতারের আগে তাঁর বয়ানও রেকর্ড করা হয়নি। তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন আইনজীবী।
আইনজীবীর সওয়াল
সোমবার অর্পিতার হয়ে ইডির বিশেষ আদালতে সওয়াল করেন আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। দিল্লি থেকে অর্পিতার হয়ে মামলা লড়তে এসেছিলেন তিনি। এর আগে মাওবাদী-যোগে ধৃত সোনি সোরির ধর্ষণ, নিগ্রহ মামলা, গুজরাতে এনকাউন্টারে নিহত ইশরাত জাহান মামলা লড়েছিলেন তিনি। এ হেন বৃন্দা এ বার অর্পিতার জামিনের হয়ে সওয়াল করছেন। প্রথম দিন সওয়াল করতে এসেই বৃন্দা আঙুল তুললেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের দিকে। ইডি যদিও আইনজীবী বদলের নেপথ্যে অর্পিতার ‘প্রভাবশালী ভূমিকা’ই দেখেছে। ইডির আইনজীবী জানিয়েছেন, অর্পিতা নিজের আইনজীবীর জন্য যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারি ‘প্ল্যাকার্ড’ রয়েছে। তাঁর দাবি, এর থেকে স্পষ্ট, অভিযুক্ত কতটা ‘ক্ষমতাবান’। এই যুক্তি দেখিয়েই অর্পিতার জামিনের বিরোধিতা করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
অর্পিতা ‘ডিফ্যাক্টো রানি’
অর্পিতা যে পরিস্থিতির শিকার, তা মানতে চায়নি ইডি। ইডির তরফে জানানো হয়েছে, তিনিও সমান ভাবে দোষী। অর্পিতা যে সব সংস্থার সঙ্গে জড়িত, সেই সব সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এই দাবি করেছে ইডি। অর্পিতার বিরুদ্ধে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে ইডির তরফে জানানো হয়েছে, ওই সব সংস্থা থেকে তিনিও লাভবান হয়েছিলেন। পার্থের ৩১টি এলআইসি পলিসির ‘নমিনি’ ছিলেন অর্পিতা। প্রত্যেকটিতে তাঁর সই রয়েছে। সেখানে পার্থকে তাঁর ‘কাকু’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইডির প্রশ্ন, তার পরেও অর্পিতা কী ভাবে বলেন, পার্থের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের দাবি, পার্থ রাজা হলে অর্পিতা ‘ডিফ্যাক্টো রানি’। এখন দুটো ‘কাকু’ রয়েছে, কালীঘাটের কাকু এবং অন্য জন পার্থ। ইডি আরও প্রশ্ন তুলেছে, অর্পিতা দুর্নীতির বিষয়ে কিছুই না জানলে নিজের ফ্ল্যাটে কোটি কোটি টাকা, গয়না রাখতে দিলেন কেন? সম্পত্তির নথিতে সই করতেন কেন? তারা এ-ও জানিয়েছে, বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্যই টাকার প্রয়োজন ছিল অর্পিতার। আর এখন তারই ফল ভোগ করছেন।
আদালতে নীরব অর্পিতা
আদালতে তাঁর আইনজীবী বার বার দাবি করেছেন, দুর্নীতিতে অর্পিতার কোনও ভূমিকা নেই। তিনি কিছু জানতেন না। পার্থই সব কিছুর নেপথ্যে রয়েছেন। সোমবার আদালত থেকে বেরিয়ে অর্পিতা কিন্তু একটি কথাও বলেননি। সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদালতের লকআপ থেকে বার করার সময় তাঁকে সাংবাদিকেরা বার বার প্রশ্ন করেন, পার্থই কি ‘মাস্টারমাইন্ড’? অর্পিতা কি পরিস্থিতির শিকার? এ সবের জবাবে অর্পিতা শুধু বলেন, ‘‘এখন কিছু বলতে পারব না।’’ তার পর উঠে যান প্রিজন ভ্যানে। সোমবার আদালতে প্রবেশের সময়ও সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অভিযুক্ত অর্পিতা। প্রশ্ন করা হয়, তাঁর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকা কার? এই প্রশ্ন শুনে অতীতে জবাব দিলেও সোমবার চুপ থাকলেন অর্পিতা। অতীতে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। তিনি উচ্চ বংশের মেয়ে।
নোটের পাহাড়
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে গত বছর ২২ জুলাই পার্থের নাকতলার বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে ইডি। জেরা করে তৃণমূলের প্রাক্তন মহাসচিবকে। পাশাপাশি, ইডি তল্লাশি চালায় অর্পিতার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটেও। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়। সঙ্গে গয়না এবং মোবাইল ফোন। ইডি দাবি করে, অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে তারা। ব্যাঙ্ক থেকে চারটি নোট গোনার যন্ত্র নিয়ে গিয়ে গণনা করা হয়েছিল টাকা। পার্থের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় অর্পিতাকে। এর পর পার্থের সঙ্গে অর্পিতার একাধিক যৌথ সম্পত্তির হদিস পায় ইডি। অর্পিতার বেলঘরিয়ার বহুতলেও দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় ইডি। একটি ফ্ল্যাট থেকে তেমন কিছু না মিললেও দ্বিতীয়টি থেকে উদ্ধার হয় আগের মতোই টাকা এবং সোনা। শান্তিনিকেতনেও পার্থ এবং অর্পিতার সম্পত্তির হদিস মেলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy