Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Anubrata Mondal

কোন কেষ্টদা? বাড়ির সামনেই প্রশ্ন করলেন যুবক

বাড়ির নামফলকে জ্বলজ্বল করছে সুকন্যা মণ্ডলের নাম। ফলকের তলায় একটা বিজ্ঞপ্তি এখনও থেকে গিয়েছে, যেখানে লেখা ‘জেলা সভাপতির বাড়িতে সাক্ষাৎ করার জন্য কেউ ভিড় করবেন না...’

Anubrata Mondal\\\'s house

বোলপুরে অনুব্রত মণ্ডলের শুনশান বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বোলপুর শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৩ ০৬:২২
Share: Save:

স্রেফ ভোজবাজির মতো উবে যাওয়া বোধহয় একেই বলে!

বোলপুরের নিচুপট্টির গমগমে বাড়ি ভরসন্ধ্যাতেও অন্ধকার। নীচের অফিসে দু’তিন জন পুলিশকর্মী গল্প করছেন। বাড়ির নামফলকে জ্বলজ্বল করছে সুকন্যা মণ্ডলের নাম। ফলকের তলায় একটা বিজ্ঞপ্তি এখনও থেকে গিয়েছে, যেখানে লেখা ‘জেলা সভাপতির বাড়িতে সাক্ষাৎ করার জন্য কেউ ভিড় করবেন না...’

ভিড়? বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার হুঙ্কার দেওয়া অনুব্রত নিজে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে গিয়েছেন বীরভূম থেকে। বাড়ির তো এই অবস্থা। অদূরে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ হাতে নিবিষ্ট যুবককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘অবস্থা কী বুঝছেন? কেষ্টদা তো নেই এখন।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কোন কেষ্টদা?’’ দু’সেকেন্ড পরের জবাব, ‘‘কে কবে আছে, কবে নেই, তাতে আমাদের কী বলুন তো!’’ মনে পড়ল, কেষ্ট-জমানার রমরমা অবস্থায় এই সব দোকানেই প্রশ্ন করলে ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান’-এর ভঙ্গিতে কে আগে ক’টা ভাল কথা বলবে সে নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু হত। এর নামই পরিবর্তন! দলের অফিস খাঁ-খাঁ করে দিনের বেশির ভাগ সময়। লোকজনের যাওয়া-আসা, হাঁকডাক কিছুই প্রায় নেই। দলের কোনও বৈঠক থাকলে তবু দু’-চার জনের পা পড়ে। না হলে শুনশান। কেষ্টহীন বীরভূমের ভোটবাজারে এখন তৃণমূলের অন্দরে তিনটে ভাগ। প্রথম ভাগ, যাঁরা মনে করেন কেষ্ট অর্থাৎ অনুব্রত মণ্ডলের তিহাড় যাত্রা তাঁদের কপাল খুলে দিয়েছে। কারণ এত বছর অনুব্রতের ছায়ায় ঢেকে থেকে তাঁরা মাথা তোলার জায়গাই পাননি। এখন সুযোগ মিলতে শুধু মাথা তোলা নয়, কেষ্টর নাম পর্যন্ত মুছে দিতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয় ভাগ, যাঁরা প্রবল কেষ্ট-অনুগামী হয়েও ‘বুকে পাথর চেপে’ দাদা-র নামটাও মুখে না আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাণপণ। কারণ, তাঁদের চোখকান অহরহ হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, আপাতত সেটাই নিরাপদ। আর তৃতীয় ভাগে রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা অত লুকোচুরি খেলতে অভ্যস্ত নন। মুখ চুন করে তাঁরা প্রায় রোজই পার্টি অফিসে যাচ্ছেন, বসে থাকছেন। তাঁদের সঙ্গে কেউ কোনও কথাও বলছে না, কাজেও লাগাচ্ছে না। তাঁরা ফুঁসছেন নিজের মনেই, ‘দাদার কাছের লোক হওয়াতেই তো এই হেনস্থা! দাদাকে ছাড়া ভোটের ফল কী-হয়, এ বার বুঝবে!’ আপাতত এঁরা জল মাপছেন চুপচাপ।

পঞ্চায়েত ভোটে অনুব্রতের ‘দেখানো পথ’ পুরোদস্তুর খোলা আছে। সে পথে ‘খেলা’-ও হচ্ছে জোরকদমে। বিনা ভোটে জয়ও আছে। কিন্তু জেলায় দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর ছবি উধাও। দলের সভাতেও বক্তাদের মুখে তাঁর নাম কার্যত শোনাই যাচ্ছে না। সিউড়িতে দিন কয়েক আগে তৃণমূল কার্যালয়ের সামনে তাঁর ছবি আর ব্যানার দেখা গেলেও সেটা যে নেহাতই ব্যতিক্রম, তা মানছেন সকলেই।

যে কোনও ভোটের আগে প্রতি বার নানা রকম চমক সৃষ্টি করা অনুব্রত আপাতত মুছে গিয়েছেন জেলা জুড়েই। পরিস্থিতি এমনই যে, একদা প্রবল কেষ্ট-বিরোধী বলে পরিচিত নেতা, নানুর ব্লক তৃণমূলের কার্যনির্বাহী সভাপতি, এ বারের প্রার্থী কাজল শেখ নানুরের পাপুড়িতে তাঁর দলীয় কার্যালয়ে বসে সরাসরি বলেই দিলেন, ‘‘কেষ্টদার আর ফেরার আশা দেখছি না। কিন্তু তা বলে দল তো আর থেমে থাকবে না। যাদের জনসংযোগ আছে, তারা দলে উঠে আসছে। প্রশ্ন হল, মানুষের কাছে সেই গ্রহণযোগ্যতা আছে ক’জনের? নিজের দমে ভোটে লড়ে জিততে পারবে এখানকার ক’জন?’’

জেলায় জোর গুঞ্জন, একাধিক খুন ও সন্ত্রাসের ঘটনায় অতীতে অভিযুক্ত কাজল ইতিমধ্যেই নিজেকে অনুব্রতের বিকল্প ভাবা শুরু করেছেন। জেলার কোর কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার পরে সেই ভাবনা প্রতি মুহূর্তে তাঁর আচরণেও প্রকাশ পাচ্ছে। সরাসরি প্রশ্নটা করতেই কাজল এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বললেন, ‘‘বিকল্প ভাবার কী আছে? আর বিকল্প হতেই বা যাব কেন? আমি নিজের জোরে রাজনীতি করি। কেষ্টদা আর আমি একসঙ্গেই দলের কাজ শুরু করেছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত মাথায় থাকলে সবাই নেতা হতে পারে। নিজের জোরে পারে ক’জন?’’ এর অর্থ কি আপনার মাথায় কারও হাত নেই, না-কি আপনি হাতের তোয়াক্কা করেন না? সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘আপনারা যেমনটা ব্যাখ্যা করবেন!’’

যে দিন কাজলের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সে দিনই দলের অন্য বেশ কয়েক জন নেতা খয়রাশোল গিয়েছিলেন। সেখানে কিছুটা অস্বস্তিতে আছে তৃণমূল। মাসের শেষে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের খয়রাশোল যাওয়ার খবর ছিল নেতাদের কাছে। তাই এলাকায় সেই সংক্রান্ত আগাম প্রস্তুতি নিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। ওই দলে আপনাকে নেওয়া হল না? চোয়াল শক্ত হয় কাজলের। বলেন, ‘‘না, আমাকে যাওয়ার কথা কিছু বলেনি।’’ বাক্যটা শেষ করেই অবশ্য তির্যক হাসি খেলে তাঁর মুখে। ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে আসবেন না, সেই খবরটাই তো পায়নি! তা হলেই বুঝুন কেমন নেতা ওরা। না পারে নিজের জোরে ভোটে জিততে, না পারে বিরোধীদের চাপে রাখতে। আর না আছে দলের মাথাদের সঙ্গে ওদের কোনও ‘হটলাইন কানেকশন’! এদের নিয়ে দল চলবে না কি?’’

যাঁদের উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলা, তাঁরা এর পাল্টা কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। প্রশ্নও তোলেননি, এই মুহূর্তে কাজলের ‘হটলাইন’টা কে! মন্ত্রী তথা অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত চন্দ্রনাথ সিংহ শুধু বলেছেন, ‘‘সব কথার উত্তর হয় না। হ্যাঁ, সভাপতি হাজির নেই বলে এই মুহূর্তে দলে কিছু অসুবিধা তো আছেই। ফান্ডের সমস্যা হচ্ছে। দেওয়াল লেখার কাজ শেষ করানো যাচ্ছে না। ভোটের আগে ওর মতো করে কর্মীদের ‘বুস্টার ডোজ’ দেওয়ার কেউ নেই। কিন্তু কাজটা তো সবাই মিলে করা হত। কাজটা তো ও একা করত না। প্রচারের আলোয় ও একা আসত মানে, জেলায় দলের সাফল্যে আর কারও ভূমিকা নেই, তা তো নয়। দলের কর্মীরা ওকে ভোলেনি। কেষ্ট মণ্ডলকে ভুললে যাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে, তারা ভুলেছে।’’

এই খোঁচা-পাল্টা খোঁচায় কতটা সুবিধা করতে পারবেন বিরোধীরা? বিজেপির বোলপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সন্ন্যাসীচরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘এই দলের নেতাদের নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি দেখে দেখে মানুষ ক্লান্ত। ভোটে সেই প্রভাব পড়বেই।’’

বস্তুত, খেয়োখেয়িই যে দলকে চাপে ফেলছে তা জনান্তিকে মানছেন অনেকেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সক্রিয় কর্মীরা যখন প্রচারে ব্যস্ত, তখন বোলপুরের অন্ধকার এক মাঠে চেয়ার পেতে দলের অন্দরে তৃতীয় ভাগে যাঁদের অবস্থান, তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘বিরোধীরা এত খোলামেলা মিটিং, মিছিল করছে দাদা নেই বলেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের সংখ্যাও গত বারের তুলনায় এ বার কম। আসলে দাদার একটা হাঁকই যথেষ্ট ছিল অনেকের মাথা নোয়ানোর পক্ষে। এখন সেই হাঁক দেওয়ার লোক আছে নাকি? ভোটে এর প্রভাব পড়বে। ভোটের ফল বেরোনোর পরে রক্তপাতও বাড়তে পারে।’’

ময়ূরেশ্বর, রামপুরহাট, মহম্মদবাজার, খয়রাশোল, সিউড়ি ১-এর মতো জায়গায় দল যেমন চাপে, তেমনই চাপে সাধারণ মানুষ। অতীতে ভোট ঘিরে বোমাবাজি, রক্তপাত, খুনের সাক্ষী থেকেছে জেলা। এ বার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা আঁচ করতে পারছেন না ঠিক কখন, কোন পথে রক্ত ঝরবে। বুঝে উঠতে পারছেন না, ঠিক কোন মুহূর্তে কোন নিরীহ মানুষের প্রাণ যাবে।

অনুব্রতের গরহাজিরায় ভোটবাজারে রং কিছুটা ফিকে বীরভূমে। কিন্তু ‘খেলা’-য় ‘গুড়-বাতাসা’-র মিষ্টত্বের আড়ালে ‘পাঁচনবাড়ি’-র প্রহারের ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে! আর বীরভূম থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে তিহাড় জেলে বসে অনুব্রত প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন, দিন সত্যিই কারও সমান যায় না। প্রমাণ করছেন, তর্জন-গর্জন, হুমকি, সন্ত্রাসের পরেও এক প্রবল একাকিত্বের জীবন অপেক্ষা করতে পারে। যে জীবনে মাথার উপর থেকে প্রায় সব হাতই সরে যায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy