থানায় ঢুকে পুলিশের উপরে হামলার অভিযুক্ত তৃণমূলের জেলা যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষকে গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার বোলপুর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখালেন কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা। নিজস্ব চিত্র।
পাড়ুই-কাণ্ডে নেত্রীর দেখানো পথে হাঁটলেন ‘সংগঠক’ও। পুলিশ পেটানোর জন্য অনুগামীর নাম পুলিশের খাতায় উঠলেও তাঁকে দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন। বীরভূমে তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের এ হেন সার্টিফিকেটের পরে অভিযুক্ত সেই তৃণমূল যুবনেতা সুদীপ্ত ঘোষকে ছোঁয়ার সাহস পুলিশের আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে পুলিশের অন্দরেই সংশয় দেখা দিয়েছে। ঘটনার চার দিন পরেও সুদীপ্তবাবু অধরা।
এবং বিরোধীরা তো বটেই, ঘটনা-পরম্পরার মধ্যে রাজ্যের শাসকদলের ‘ট্র্যাডিশন’রক্ষার তাগিদ দেখছেন প্রশাসনিক মহলেরও একাংশ। তাঁদের বক্তব্য: পাড়ুইয়ের সাড়া জাগানো সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডে অনুব্রতের নাম জড়ানোর পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘ভাল সংগঠক’ হিসেবে অভিহিত করে প্রশংসিত করেছিলেন। তার পরে গ্রেফতার তো দূর, সাগর-খুনে মূল অভিযুক্ত অনুব্রতের নাম চার্জশিটেই ঠাঁই পায়নি! এ বার মুখ্যমন্ত্রীর ঢঙেই প্রকাশ্যে সুদীপ্ত ঘোষকে ‘ভাল ছেলে’ হিসেবে অভিহিত করেছেন অনুব্রত। রবিবার বীরভূমের মুরারই থানার পাইকর হাইস্কুলে আয়োজিত দলীয় কর্মিসভায় সাংবাদিকদের কাছে তৃণমূল জেলা সভাপতি বলেন, “সুদীপ্ত কিছু করেনি। ও খুব ভাল ছেলে।”
কিন্তু জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি সুদীপ্তই তো বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোয় মূল অভিযুক্ত! বুধবার রাতের ওই ঘটনার পরে পুলিশই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুদীপ্ত ও তাঁর ৯ সঙ্গীর নামে জামিন-অযোগ্য ধারায় এফআইআর করেছে! সেটা কি মিথ্যে? বিভিন্ন মহলে প্রশ্নটি জাগলেও অনুব্রত তাঁর পর্যবেক্ষণে অবিচল। “সুদীপ্ত কিছু করেনি।” এ দিন নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন তিনি। যা শুনে উপস্থিত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঢালাও হাততালি দিলেও প্রমাদ গুনেছেন জেলা পুলিশের নিচুতলার কর্মীরা। তাঁদের আশঙ্কা, অনুব্রতের মুখে এমন কথা শুনে কর্তারা আর সুদীপ্তকে গ্রেফতার করতে এগোবেন না। “মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকায় পাড়ুই-মামলায় খোদ ডিজি হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে অনুব্রতের হয়ে সওয়াল করে গেলেন! এখন অনুব্রত বলছেন, সুদীপ্ত নির্দোষ! অন্য কিছু ভাবার মতো বুকের পাটা কার হবে?” প্রশ্ন এক পুলিশকর্মীর।
গত ফেব্রুয়ারিতে দুর্গাপুরে তৃণমূল ছাত্র-যুবাদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী জানান, অনুব্রত ভাল সংগঠক। আক্ষেপ করেন, অনুব্রতের পিছনে ‘কেউ কেউ লাগে।’ কিন্তু ভাল সংগঠকের পিছনে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকবেন বলে ঘোষণাও করেন মুখ্যমন্ত্রী। বস্তুতই সেই থেকে নেত্রী বার বার আড়াল করে এসেছেন সংগঠককে। এমনকী, লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অনুব্রতকে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছে। যার প্রেক্ষাপটে তোপ দাগে হাইকোর্ট। আদালত তখন মনে করেছিল, মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রশ্রয়ের’ কারণেই পাাড়ুই-মামলার বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) অনুব্রতকে গ্রেফতার করছে না। গত ১০ এপ্রিলের নির্দেশে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত লিখেছিলেন, ‘অনুব্রত মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হওয়ায় সিটের প্রধান (রাজ্য পুলিশের ডিজি) ও অন্য অফিসারেরা তাঁকে ছোঁয়ার সাহস করছেন না। অভিযুক্তও সেই রাজনৈতিক সুযোগটি পুরোপুরি ব্যবহার করছেন।’
এ বার সুদীপ্ত ঘোষের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে বলে মনে করছেন বীরভূম জেলার পুলিশকর্মীদের বড় অংশ। “মামলা তো আজই শেষ হয়ে গেল! কেষ্টদা (অনুব্রত) যখন এমন কথা বলে দিয়েছেন, তখন পুলিশের হাত কামড়ে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।” এ দিন মন্তব্য করেন বোলপুর থানার এক পুলিশকর্মী। উল্লেখ্য, বুধবার রাতে মদ্যপ সুদীপ্ত দলবল নিয়ে এই বোলপুর থানায় চড়াও হয়ে ডিউটি অফিসারকে নিগ্রহ করেন বলে অভিযোগ। পুলিশের নিচুতলার ক্ষোভ সামাল দিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে সুদীপ্ত-সহ দশ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করার অনুমতি দেয় নবান্ন। যদি যুবনেতাকে গ্রেফতারের কোনও চাড় পুলিশের দিক থেকে এখনও নেই।
মামলা রুজু হওয়ার পরে সুদীপ্তকে অবশ্য বহাল তবিয়তে এলাকায় ঘুরতে দেখা গিয়েছে। বোলপুর শহরে মিশন কম্পাউন্ড, হরগৌরীতলার বাসিন্দারা তাঁকে দেখেছেন। খাওয়া-দাওয়ার জন্য তিনি বাড়িতেও যাচ্ছেন। যদিও অভিযুক্ত যুবনেতা সাংবাদিকদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না, সাংবাদিকদের ফোনও ধরছেন না। বোলপুর পুরসভার স্যানিটেশন অফিসার সুদীপ্ত গত তিন দিন (বৃহস্পতি থেকে শনিবার) হাজিরা খাতায় সইও করেছেন। তৃণমূল পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত এ দিন বলেন, “বৃহস্পতি, শুক্রবারের কথা জানি না। তবে শনিবার আমি নিজে সুদীপ্তবাবুকে অফিস করতে দেখেছি।”
থানারই গা ঘেঁষে বোলপুর পুরসভা। পুর-চেয়ারম্যান নিজেই জানাচ্ছেন, তিনি অভিযুক্তকে অফিসে দেখেছেন। পুলিশ দেখতে পাচ্ছে না কেন? পুলিশের উঁচুতলার কাছে ব্যাখ্যা মেলেনি। বারবার ফোন করা হলেও বীরভূমের এসপি অলোক রাজোরিয়া এ দিন ফোন ধরেননি। বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদবও তাই। রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিও ফোন ধরেননি, তাঁর কাছ থেকে এসএমএসের জবাব পাওয়া যায়নি।
পুলিশকর্তাদের ভূমিকা দেখে বিরোধীরা স্বভাবতই সুর চড়াচ্ছে। বিজেপি’র বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল এ দিন বলেন, “শাসকদলের লোক হলে এফআইআর সত্ত্বেও পুলিশ ধরবে না। অনুব্রত থেকে সুদীপ্ত এই জেলায় এটাই দস্তুর।” সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহা ও মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডলের প্রসঙ্গ তুলে দুধকুমারের মন্তব্য, “রোগটা এখন গোটা রাজ্যেই ছড়াচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy