Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সীমান্তে সক্রিয় দুষ্কৃতীরা, সামাল দিতে বৈঠক

সপ্তাহখানেক আগের মাঝরাত। শিলিগুড়ি মহকুমার গঙ্গারাম চা বাগানের বাসিন্দার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ শুনেই, প্রবীণ বাসিন্দারা বুঝতে পারেন, ‘ওপারে’র লোকেরা ঢুকে পড়েছে বাগানের আনাচে কানাচে। কয়েরকজন বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেন, কমপক্ষে ২০ জন সশস্ত্র দুষ্কৃতী। কয়েকজনের হাতে চকচক করছে কিছু ধারাল অস্ত্রও। এর পরে নিজেদের মোবাইলে, চিৎকার করে যোগাযোগ করেন চা শ্রমিকেরা। দল বেঁধে লাঠিসোটা নিয়ে হইহই করে বার হতেই আর সাহাস দেখায়নি ওপারের দুষ্কৃতীরা। পালায় তারা।

ফাঁসিদেওয়ার কাঁটাতারের বেড়াহীন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত।—নিজস্ব চিত্র।

ফাঁসিদেওয়ার কাঁটাতারের বেড়াহীন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত।—নিজস্ব চিত্র।

কৌশিক চৌধুরী
ফাঁসিদেওয়া শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

সপ্তাহখানেক আগের মাঝরাত। শিলিগুড়ি মহকুমার গঙ্গারাম চা বাগানের বাসিন্দার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ শুনেই, প্রবীণ বাসিন্দারা বুঝতে পারেন, ‘ওপারে’র লোকেরা ঢুকে পড়েছে বাগানের আনাচে কানাচে। কয়েরকজন বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেন, কমপক্ষে ২০ জন সশস্ত্র দুষ্কৃতী। কয়েকজনের হাতে চকচক করছে কিছু ধারাল অস্ত্রও। এর পরে নিজেদের মোবাইলে, চিৎকার করে যোগাযোগ করেন চা শ্রমিকেরা। দল বেঁধে লাঠিসোটা নিয়ে হইহই করে বার হতেই আর সাহাস দেখায়নি ওপারের দুষ্কৃতীরা। পালায় তারা।

তার আগেই সুদামগছ, ঠাকুরপাড়া, কান্তিভিটা বা রূপনদিঘীর মত বিভিন্ন এলাকায় গরু থেকে বাড়ির জিনিসপত্রের পরপর চুরির ঘটনায় ঘুম উড়েছে গ্রামের বাসিন্দাদের। কোথাও গরু, কোথাওবা ভয় দেখিয়ে ঘরের জিনিস। বাদ থাকছে না কিছুই। গত তিন মাস ধরে ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি জুড়ে দুষ্কৃতীরা ফের সক্রিয হয়ে উঠেছে বলে পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের খবর।

মহানন্দা নদীর জন্য কিছুটা কাঁটাতার বেড়াহীন এলাকাই বরাবরের মত এবারও ওপারের দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। পুলিশের হিসাব অনুসারে, গত দুই মাসে ১০টি এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের কাছে একাধিক গণস্বাক্ষর করা অভিযোগপত্রও জমা পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ, বুধবার বিকালে ফাঁসিদেওয়ায় পুলিশ-বিএসএফ এবং প্রশাসনিক কর্তারা তড়িঘড়ি বৈঠকও ডেকেছেন।

গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত অক্টোবর মাসের আগে পরপর হামলার ঘটনা বাড়তে থাকায় পুলিশ-বিএসএফ সতর্ক হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বিএসএফের ম্যানপ্যাক ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর ঘটনাও ঘটে। এর পরে নজরদারি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাতে সীমান্তগ্রামগুলিতে শুরু হয়েছিল টহলদারিও। মাস দু’য়েক ধরে তা কিছুটা ঢিলেঢালা হতেই ফের দুষ্কৃতীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এই প্রসঙ্গে দার্জিলিঙের পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘সীমান্তে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য কোনওভাবেই বাড়তে যাওয়া যাবে না। স্থানীয় থানাগুলিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিছু স্থানীয় লোকজন এসবের মধ্যে জড়িত রয়েছে। তাদেরও খোঁজ চলছে।’’ আর বি‌এসএফের নর্থবেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি ডি হাওকিপ বলেন, ‘‘বর্যার মরসুম আসতেই অনেক সময় ওপারের দুষ্কৃতীরা সক্রিয় হওার চেষ্টা করে। তার উপরে এলাকায় নদী সীমান্ত রয়েছে। আমরা প্রতিটি সীমান্ত চৌকিকে বাড়তি নজরজদারি বাড়াতে বলেছি।’’

পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রের খবর, ফাঁসিদেওয়া ব্লকের লালদাস জোত থেকে মুড়িখাওয়া এলাকা অবধি প্রায় ২২ কিলোমিটার বাংলাদেশ সীমান্ত রয়েছে। গোটা এলাকায় চটহাট, ফাঁসিদেওয়া এবং জালাস নিজামতারা গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে বিএসএফের লালদাস, বানেশ্বর, ফাঁসিদেওয়া, কালামগছ এবং মুড়িখাওয়াতে বিএসএফের সীমান্ত চৌকি রয়েছে। সীমান্তের লালদাস থেকে ধনিয়ামোড় অবধি কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। পরবর্তী বন্দরগছর অবধি প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার কোনও বেড়া নেই। মহানন্দা নদী এবং এ পারের গ্রামের জমির সমস্যার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া যায়নি। এর সুযোগেই বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা বরবারই ফাঁসিদেওয়া সীমান্তে সক্রিয় বলে অভিযোগ।

গত সেপ্টেম্বরে মুড়িখাওয়ায় বাংলাদেশি দুষ্কৃতী ঢুকে গরু চুরি করে। মে মাসে ধনিয়ামোড় এলাকায় গাছে লুকিয়ে থাকা দুই সন্দেভাজন ধরা পড়ে। বিডিও অফিস সংলগ্ন এলাকার বাঁশঝাড় থেকে রাতে সন্দেহভাজন এক বাংলাদেশিকে ধরাও হয়। ফাঁসিদেওয়ার ২৫০ বছরের পুরানো দুটি মন্দিরে একসঙ্গে চুরির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ধনিয়মোড়, মুন্ডাবস্তি এবং বন্দরগছ এলাকার সমস্যা বেশি দেখা দেয়। বাসিন্দারা জানান, মহানন্দা নদীতে দিনভর ওপারের লোকজনের আনাগানো লেগেই থাকে। সকালে লোকজন নদীবক্ষে নেমে বালি, পাথর তুলে নিয়ে অবাধেই চলে যান ‘ওপারে’। এ ছাড়াও রাতের অন্ধকারের সুযোগকেও কাজে লাগানো শুরু করেছে দুষ্কৃতীরা।

গত বছরের শেষে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা ও পরিবারের তালিকা তৈরি হয়। নতুন কোনও লোক এলাকায় দেখে গেলেই বাসিন্দাদের তা থানা বা সীমান্ত চৌকিতে জানাতে বলা হয়। বিএসএফের নজরদারি ছাড়াও সীমান্তের গ্রাম, রাস্তায় একজন সাব ইন্সপেক্টর, একজন সশস্ত্র কনস্টেবল ছাড়াও কয়েকজন সিভিক ভলেন্টিয়ারকে দুই দফায় নজরদারির কাজে নামানো হয়। কিন্তু তা কিছুটা ঢিলেঢালা হতেই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বলে অভিযোগ। ফাঁসিদেওয়ার বিডিও বীরুপাক্ষ মিত্র বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুলিশ-বিএসএফকে নজর বাড়াতে বলা হয়েছে। আজ, বৈঠকে সব কিছু নিয়েই আলোচনা হবে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE