সেই চিঠিতে যে সব তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে আনিস অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাসুদ খানের দাবি, ‘‘সেই সময়ে আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে যে এই রকম অভিযোগ হয়েছিল, তা জানতে পেরেছি আনিসের মৃত্যুর পরে একটি চিঠি ভাইরাল হওয়ায়।’’
ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন অনেক। একটিরও উত্তর মিলছে না।
প্রায় দেড় দিন কেটে যাওয়ার পরেও রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওড়ার আমতার ছাত্র-নেতা আনিস খান হত্যা-মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে পুলিশ কোনও জবাব দিতে পারেনি। কেউ ধরা পড়েনি। জানা যায়নি, শুক্রবার গভীর রাতে কারা বাড়িতে আসার পরে আনিসকে এ ভাবে খুনের অভিযোগ উঠল? পুলিশ, নাকি পুলিশের উর্দি পরা অন্য কেউ?
প্রথম থেকেই আনিসের বাবা সালেম খানের অভিযোগ, পুলিশই তাঁর ছেলেকে বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে খুন করেছে। কিন্তু আমতা থানা রবিবারও দাবি করেছে, ওই রাতে আনিসদের বাড়িতে পুলিশ কোনও অভিযান চালায়নি। কিন্তু এর পক্ষে কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। তবে জেলা পুলিশ জানিয়েছে, আমতা ও বাগনান থানায় আনিসের নামে তিনটি মামলা ছিল।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আনিসের বাবা সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন। একই দাবি গ্রামবাসীদেরও। তাঁরা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। এ দিন সকালে পুলিশ ঘটনার তদন্তে সারদা গ্রামের খাঁ পাড়ায় আনিসদের বাড়িতে গেলে,
গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভের জেরে তখনকার মতো পুলিশ ফিরে যায়। পরে জেলার পুলিশকর্তারা আনিসের পরিবারের লোকজনকে বোঝান, তদন্তের প্রাথমিক কাজ সেরে রাখার জন্য পুলিশকে সহায়তা করা প্রয়োজন। কার্যত নিমরাজি হয় আনিসের পরিবার। ফরেন্সিক দলকে নিয়ে দুপুরের পরে নিহতের বাড়িতে যান হাওড়া জেলা (গ্রামীণ) পুলিশের ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) সুব্রত ভৌমিক। তাঁকেই এই মামলার তদন্তকারী অফিসার হিসাবে বহাল করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, মামলা শুরু হয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন), ২০১ (তথ্যপ্রমাণ লোপাট) এবং ৩৪ (একই উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া) ধারায়।
এ দিন তদন্তকারীরা বাড়িটি খুঁটিয়ে দেখেন। নিহতের পরিবারের বয়ান অনুযায়ী ছাদ থেকে বালিশ ফেলে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। বাড়ির সামনে দু’টি জায়গা এবং বাড়ির ভিতরে একটি জায়গায় চাপ চাপ রক্ত পড়েছিল। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা হয় নিহতের জামা। কাছাকাছি কোথাও সিসি-ক্যামেরা ছিল না। বাড়ি থেকে প্রায় ৮০০ মিটার দূরে একটি ক্লাবের সিসি-ক্যামেরা আছে। প্রয়োজন হলে, সেখান থেকে ছবি নেওয়া হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবীয় এ দিন ভবানী ভবনে জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার সৌম্য রায়কে তলব করেন। সৌম্য সেখানে এই ঘটনার রিপোর্ট দেন। উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে শনিবারই গ্রামে আনিসের দেহ কবর দেওয়া হয়।
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, নিহতের মাথায় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। ভিসেরা ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে যথাযথ ভাবেই তদন্ত চলছে।’’
তা হলে কেন পুলিশের উপরে ভরসা রাখতে পারছে না আনিসের পরিবার?
সালেমের বড় মেয়ে সাগিরা বিবির শ্বশুরবাড়ি পাশেই পশ্চিমপাড়ায়। শুক্রবার গভীর রাতে ভাইয়ের খুন হওয়ার কথা শুনে দুই ছেলেকে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে তিনি বাপের বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে চার সিভিক ভলান্টিয়ার তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে এবং কারণ জানার পরেও সাহায্যে এগিয়ে আসেননি এবং গুরুত্বও দেননি বলে তাঁর অভিযোগ।
পুলিশি তদন্তে অনাস্থার একাধিক কারণ দেখিয়েছেন সালেম। তিনি বলেন, ‘‘ছেলের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার কথা জানি না। তবে, বাগনান থানায় অনেক বছর আগের একটা হালকা মামলা ছিল। পুলিশ কিন্তু শুক্রবার রাতে এসে বলেছিল, বাগনান থানার একটা মামলার জন্য আমতা থানায় আনিসকে ধরার চাপ আছে। আমরা তাই এসেছি। কারা আমার ছেলেকে খুন করেছে সেটা ঘটনার পরে দেড় দিন কেটে গেলেও পুলিশ বার করতে পারল না কেন? আসলে পুলিশই এতে জড়িত। সেই কারণেই তদন্তের কাজে তারা গাফিলতি করছে। পুলিশি তদন্ত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন হবে না। একমাত্র সিবিআই-ই পারবে সত্য খুঁজে বার করতে।’’
বৃদ্ধের আরও অভিযোগ, শুক্রবার রাতে আনিস খুন হওয়ার পরে তিনি আমতা থানায় ফোন করে পুলিশকে ডাকেন। পুলিশই ছেলেকে খুন করেছে বলে জানান। পুলিশ তখনই যাওয়ার কথা বলেও আসেনি। বৃদ্ধের দাবি, ‘‘ওই রাতে পুলিশ না-আসায় শনিবার ভোরে ফের ফোন করি। পুলিশ বলে, এ বারে যাচ্ছি। তারও অনেক পরে, বেলা ৯টা নাগাদ পুলিশ আসে।’’
এ সংক্রান্ত একটি ‘অডিয়ো-ক্লিপ’ও রবিবার ‘ভাইরাল’ হয়েছে। আনন্দবাজার অবশ্য ওই অডিয়ো-ক্লিপের সত্যতা যাচাই করেনি। পুলিশের পাল্টা দাবি, নিহতের বাড়ি থেকে শুক্রবার রাতে থানায় কোনও ফোন আসেনি। পুলিশ খবর পায় শনিবার সকাল ছ’টায়। তার পরেই পুলিশ গ্রামে যায়। তবে, বাড়িটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় পৌঁছতে দেরি হয়।
আনিসের দেহের ময়না-তদন্তের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তাঁর বাবার। অভিযোগ, ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে সুরতহালও করানো হয়নি। সালেমের দাবি, ‘‘শনিবার পুলিশ নিজেদের দায়িত্বে ময়না-তদন্ত করায়। অথচ, দেহটি তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পুলিশ আমাদের থানায় ডেকেছিল। বলেছিল, আমাদের সঙ্গে নিয়ে ময়না-তদন্ত করাতে যাওয়া হবে। কিন্তু আমরা থানায় পৌঁছে দেখি, পুলিশ আগেই দেহ উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে চলে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে এই লুকোচুরি খেলা হল কেন?’’
আমতার এসডিপিও কৃষ্ণেন্দু ঘোষদস্তিদারের দাবি, ‘‘আইন মেনেই সব করা হয়েছে। সব মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহালের আইন নেই। তাই পুলিশি সুরতহাল করানো হয়েছে। তাতে ময়না-তদন্তের সময়ে নিহতের পরিবারের লোকজনও ছিলেন।’’ তবে, নিহতের পরিবারের কোন সদস্য ময়না-তদন্তের সময়ে হাজির ছিলেন, তাঁর নাম বলতে পারেনি পুলিশ। সব মিলিয়ে ঘটনার পরেও পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত অস্বচ্ছ বলেই অভিযোগ আনিসের পরিজনদের।
আনিস খুন হওয়ার পরে
তাঁর লেখা একটি চিঠিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে। গত বছর ২১ মে আমতা থানায় পাঠানো ওই চিঠিতে তাঁর অভিযোগ, এলাকায় একটি রক্তদান শিবির আয়োজনের চেষ্টা করায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা আপত্তি জানান। কারণ, তিনি বিরোধী রাজনীতি করেন। তাঁর বাড়ি, গোয়ালঘরে ভাঙচুর চালানো হয় এবং প্রতিবন্ধী বোন-সহ বাড়ির লোকজনকে মারধর করা হয়। তাঁকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয় বলে লেখা হয়েছে ওই চিঠিতে।
গ্রামবাসীরা জানান, রক্তদান শিবিরটি আয়োজন করা হয়েছিল গত বছরের ২২ মে। কিন্তু ওই গোলমালের জেরে তা আর হয়নি। আনিসের বাবা ওই চিঠির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘‘সেই সময়ে আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এখন এই প্রসঙ্গ আর তুলতে চাই না। এর সুযোগ নিয়ে রাজনীতির খেলা শুরু হবে। তাতে ছেলেকে খুনের তদন্ত গুলিয়ে যাবে।’’
সেই চিঠিতে যে সব তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে আনিস অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাসুদ খানের দাবি, ‘‘সেই সময়ে আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে যে এই রকম অভিযোগ হয়েছিল, তা জানতে পেরেছি আনিসের মৃত্যুর পরে একটি চিঠি ভাইরাল হওয়ায়।’’
রবিবার আনিসের বাড়িতে আসেন কৌশিক সেন, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়েরা। এ দিন কৌশিক বলেন, ‘‘এক প্রতিবাদী যুবককে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। তিনি তা লিখিত ভাবে সবাইকে জানিয়েছিলেন। তার পরেও তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হল না কেন? বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছি।’’ এসডিপিও জানান, চিঠিটি পুলিশের কাছে আসার পরেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy