কালি ও কলমে বুদ্ধদেব আত্মপ্রতিকৃতিই রচনা করতে চেয়েছেন।
দিন শুরু হত টেনিস খেলে। তার পর প্রাতরাশ। এ বার পকেটে পিস্তল পুরে নেওয়া। গন্তব্য টালিগঞ্জের রাইফেল ক্লাব। শ্যুটিং প্র্যাকটিস। গড় বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের চেনা খোপে এমন একটি চরিত্রকে আঁটানো হয়তো মুশকিলই ছিল। ৮৫ বছরের জীবনে বুদ্ধদেব গুহ নিজেও চাননি অন্যের মাপে বানানো জামায় গা গলাতে। শহুরে শিক্ষিত সমাজকে ‘ভণ্ড’ আর নিজেকে ‘জংলি’ বলে পরিচয় দিতেও তাঁর বাধেনি কখনও। ফলে এক হাতে বন্দুক উঠেছে ঠিকই, কিন্তু অপর হাতে বিলক্ষণ বেস্টসেলার।
জনপ্রিয়তা নামক টক আঙুরফলটির প্রতি মধ্যমেধার বাঙালির মোহ ও বিদ্বেষ যুগপৎ বর্তমান। সেই প্রবণতার মূলে আঘাত করেছিলেন বুদ্ধদেব। ভালবাসাকে পুঁজি করে সাধারণ পাঠকের মন ছুঁতে চেয়েছিলেন। যৌনতার গা থেকে খুলে দিতে পেরেছিলেন ট্যাবুর পোশাক। শরীরী প্রেমে মিশিয়ে দিয়েছিলেন পবিত্রতার সুবাস। তাই কোট-আনকোট ‘মহৎ’ সাহিত্য তিনি সৃষ্টি করে যেতে পেরেছেন কি পারেননি, এই তাত্ত্বিক বিতর্ক অনেক দিনই ম্লান হয়ে গিয়েছে তাঁর ‘সফল’ সাহিত্যের প্রবল প্রতাপে। লেখার মধ্যে নিজেকেও লুকিয়ে রাখতে চাননি কখনও। নিজের জীবনচরিতেরই খসড়া করে গিয়েছেন অবিরাম। জঙ্গলে, প্রেমে, নারীসঙ্গে বার বার নিজেকে উন্মুক্ত করেছেন। শত-সহস্র টুকরোয় ভেঙেছেন। তা থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘মাধুকরী’-র পৃথু ঘোষ, ‘কোজাগর’-এর সায়ন, ‘কোয়েলের কাছে’-র লালসাহেবরা। কল্পনার সার-জল হয়তো তাদের পুষ্ট করেছে। পূর্ণ অবয়ব দিয়েছে। কিন্তু কালি ও কলমে বুদ্ধদেব আত্মপ্রতিকৃতিই রচনা করতে চেয়েছেন। সৎ সাহস ও বড় মন না থাকলে চট করে এই ফাঁদে কেউ পা দেন না— সে তিনি শিকারিই হোন বা শিকার।
থিয়েটার করেছেন। ছবি এঁকেছেন। সঙ্গীতের চর্চায় দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়, সেই ছেলেবেলা থেকে। তাঁর রঙিন মন আমৃত্যু ফিকে হয়নি। এই বহুমুখী বর্ণময় জীবনের নেপথ্যে ছিল প্রাণশক্তি। অকৃত্রিম ভালবাসা। জীবনের প্রতি যে প্রেমময় আর্তি ঝরে পড়ে তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রদের কণ্ঠেও: ‘আমাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখ — অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখ, হে সূর্য, হে সুপুরুষতম সুপুরুষ, হে আনন্দের আনন্দ। আমাকে আরও অনেক দিন, অনেক দিন তোমার আলোয় ভরা পৃথিবীতে, তোমার পাখিডাকা বনে বনে একটি মুগ্ধ ভক্ত অনাবিল মন নিয়ে সুন্দরের খোঁজে খোঁজে ফেরাও।... আমাকে বাঁচিয়ে রাখ — বহুদিন, নিশিদিন, অনুক্ষণ — অনুক্ষণ।... পৃথিবী যতদিন বাঁচবে, গাছে গাছে যতদিন ফুল ফুটবে, নির্জন ঘাসে যতদিন কাঁচপোকা গুনগুনিয়ে ফিরবে, আমাকে ততদিন বাঁচিয়ে রাখ হে সূর্য — আমাকে ততদিন প্রাণদান কর (নগ্ননির্জন)।’
শুধু লেখক হিসেবে নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও ছিলেন ভালবাসার কাঙাল। এক দশক আগে চলে গিয়েছেন যে প্রিয়জন, তাঁর সঙ্গে প্রেম নিয়েই লিখেছিলেন ‘খেলা যখন’। ঋতু গুহ। রবীন্দ্র গানের এক স্বতন্ত্র ধারার শিল্পী। এই দাম্পত্য প্রসঙ্গে একাধিক সাক্ষাৎকারে অকপট ছিলেন বুদ্ধদেব। গানের সূত্রেই ঋতুকে চেনা। মুগ্ধ হওয়া। দু'জনেই তখন ‘দক্ষিণী’-তে গান শিখছেন। তেমন আলাপ নেই। তবু অকুতোভয় বুদ্ধদেব পকেটে চিঠি নিয়ে চললেন ‘প্রোপোজ’ করতে। ঘামে ভিজে নষ্ট হল সেই চিঠি। ফের চিঠি লেখা, পুনরায় অভিযান। পাত্রীর হাতে যদি বা পৌঁছল প্রেমপত্র, উত্তর মিলল না। রাগে-অপমানে তখন মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম। সবে তখন ঋতুর ৪৮ আরপিএম-এর রেকর্ড বেরিয়েছে। গড়ের মাঠে গিয়ে লাথি মেরে সেই রেকর্ড চুরচুর করে ভেঙে ফেললেন বুদ্ধদেব! তবে দিন কয়েক অপেক্ষার পর অবশেষে এল ঋতুপরিবর্তন। মিলল সম্মতি। ১৯৬২ সালে শুরু হয়েছিল তাঁদের বিবাহিত জীবন।
অল্প বয়সে গান শেখার শুরু বুদ্ধদেবের। তুলসি লাহিড়ীর ভাই সামু লাহিড়ীর কাছে। তার পর ‘দক্ষিণী’। কিন্তু থিয়োরি মেনে গান গাওয়ার ধাত তাঁর কোনও দিনই ছিল না। তাই স্বাভাবিক নির্বাচন হিসেবে দেবব্রত বিশ্বাসের স্বাধীন ছায়ায় আশ্রয় খোঁজা। জর্জ বিশ্বাসের শিষ্য হয়েও রবীন্দ্রনাথের পথ আঁকড়ে থাকেননি। বুদ্ধদেব নিজেই বলেছেন, ঋতুর আপত্তিতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে দূরে সরে যান তিনি। মেতে ওঠেন পুরাতনী গানের চর্চায়। অসামান্য রসবোধ থেকে অম্লানবদনে এ-ও বলতেন, তিনি বাথরুমে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও দরজা ধাক্কাতে কসুর করেননি ঋতু! ২০১১-র ২৪ ডিসেম্বর ঋতুর মৃত্যুর পর থেকে বিচ্ছেদ নেমে আসে সেই দাম্পত্যে।
বুদ্ধদেব তাঁর এক চরিত্রকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘আমার ভারী ইচ্ছে করে আমার কোনও ভীষণ সুখের মুহূর্তে এমন সুন্দর কোনও পথে হাঁটতে হাঁটতে কোনোদিন আমি জাস্ট ফেড-আউট করে যাব। তারপর আমাকে কেউ ডাকলেও আমি ফিরব না — আমি নিজে — ডাকলেও আমি আর সাড়া দেব না। অথচ আমি আমার চারপাশের অন্ধকারেই ছড়িয়ে থাকব — ঝিঁঝির ডাক হয়ে থাকব, জোনাকি হয়ে থাকব — তারার আলোয় দ্যুতিমান শিশিরবিন্দু হয়ে থাকব, ঝরাপাতা হয়ে থাকব...।’ বাস্তবে কি আর এমন ইচ্ছে পূরণ হওয়া সম্ভব? শেষ পর্যন্ত জীবনে তাই অতৃপ্তি থেকেই যাবে। তবু আমাদের মনে থেকে যাবে স্রেফ ভালবাসা খুঁজতে আসা এক ব্যতিক্রমী লেখককে। মনে থেকে যাবে তাঁর দরাজ গলার গান—
কিছুই তো হল না।
সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব,
সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy