গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
নীলবাড়ি দখলের লক্ষ্যে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ বারবার দিয়েছেন অমিত শাহ। দিল্লিতে বা রাজ্য সফরে সব বৈঠকেই এটা অমিতের সামগ্রিক নির্দেশ হিসাবে থাকে। কিন্তু তাতে যে ‘কাজের কাজ’ হয়নি, তা দলের সাম্প্রতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্পষ্ট। তার জেরে বিভিন্ন নেতার অনুগামীদের মধ্যেও জমছে ক্ষোভ। অনেক সময় তা প্রকাশ্যেও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সে বিষয়ে ‘অসন্তুষ্ট’ বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিজেপি সূত্রে খবর, এ বার রাজ্য নেতাদের সরাসরি ‘ঐক্য প্রদর্শন’-এর নির্দেশ দিয়েছেন অমিত। তার ফল হিসাবে কলকাতায় আগামী সোমবারের মিছিলে ‘আদি’, ‘নব্য’ সব নেতাকে সামিল করতে তৎপর রাজ্য বিজেপি।
বঙ্গ বিজেপি-র অন্দরেই এই আলোচনা রয়েছে যে, মঞ্চে গলায়-গলায় ভাব দেখালেও দিলীপ ঘোষ-শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্কে একটা ‘শৈত্য’ রয়েছে। মুকুল রায়ের সঙ্গে দিলীপের দূরত্বও কমেনি। গত কয়েকদিনে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। রাজ্য বিজেপি-র এক শীর্ষনেতার বক্তব্য, ‘‘আগে কোথায়, কোন কর্মসূচিতে কে কে থাকবেন তা রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষে কেন্দ্রীয় ভাবে ঠিক হত। ইদানীং সেটা আর হচ্ছে না। নেতারা বেশির ভাগ সময়েই নিজের নিজের মতো করে স্থানীয় নেতৃত্বকে কর্মসূচির দিনক্ষণ জানিয়ে দিচ্ছেন। কোন নেতা কবে, কোথায়, কোন কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জানা যাচ্ছে একেবারে শেষ মুহূর্তে।’’ এর ফলে ভুল বোঝাবুঝির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলেও দাবি ওই নেতার।
রাজ্য বিজেপি নেতাদের মধ্যে এই ‘সমন্বয়ের অভাব’ নজরে পড়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। তা নিয়ে দল যে ‘চিন্তিত’, সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে রাজ্যের নেতাদের আবার সতর্ক করেছেন অমিত। শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লির বাসভবনে রাজ্য নেতৃত্বকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন অমিত। প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে দিলীপ, মুকুল ছাড়াও রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং শিব প্রকাশ হাজির ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তীও।
বৈঠকে সরাসরি প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের কথা না তুললেও ঠারেঠোরে অমিত বুঝিয়ে দিয়েছেন, একসঙ্গে চলতেই হবে! গোষ্ঠীকোন্দলের কোনও অভিযোগ মেনে নেওয়া যাবে না। আগামিদিনে আরও অনেকে অন্য দল থেকে বিজেপি-তে এলে সেই নবাগতদেরও যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।
সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি হওয়ার পরেও রাজ্য বিজেপি তাঁকে ঠিক মতো কাজে লাগাচ্ছে না বলে ঘনিষ্ঠদের কাছে প্রায়শই অনুযোগ প্রকাশ করেন মুকুল। এরই মধ্যে গত বুধবার মুকুল-দিলীপ দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় হাওড়া ময়দানে বিজেপি-র সমাবেশে। সে দিন সমাবেশের আগে ডুমুরজলা স্টেডিয়াম থেকে হওয়া মিছিলে থাকার কথা থাকলেও অনুপস্থিত ছিলেন মুকুল। মিছিলে না গিয়ে আগেভাগে সমাবেশস্থলে চলে যান তিনি। প্রায় ২ ঘণ্টা ফাঁকা সমাবেশস্থলেই বসে থাকার পরে মিছিল নিয়ে দিলীপ সেখানে আসতে না আসতেই হাওড়া ময়দান ছেড়ে চলে যান মুকুল।
ওই মিছিল নিয়ে অন্য বিতর্কও তৈরি হয়েছিল। প্রথমে ঠিক ছিল, ১১ জানুয়ারি ওই মিছিল হবে। ঠিক ছিল, সেখানে শুভেন্দুও থাকবেন। কিন্তু দিলীপ সে দিন দিল্লি যাবেন জানানোয় মিছিলের তারিখ বদলে ১৩ জানুয়ারি করা হয়। সমাবেশে দিলীপ-মুকুল-শুভেন্দু থাকবেন বলেই প্রচার হয়। সেই মতো ফেস্টুন, ব্যানারও পড়ে হাওড়ায়। কিন্তু সমাবেশের আগের রাতে শুভেন্দু জানিয়ে দেন, অন্য কর্মসূচি থাকায় তিনি হাওড়ায় আসতে পারছেন না। শুভেন্দু অনুগামীদের একাংশের বক্তব্য, বিজেপি-তে দাদার গুরুত্ব দিলীপ ঘোষের থেকে কম নয়। তাই ওঁর জন্য কর্মসূচি পিছিয়ে গেলে দাদাকে তা মেনে নিতে হবে, এমন কোনও কথা নেই।’’ যদিও শুভেন্দু-অনুগামীদের অপর গোষ্ঠী ওই মতদ্বৈততার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, প্রতিটি কর্মসূচিতেই শুভেন্দু এবং দিলীপ নিজেদের একে অপরের পরিপূরক হিসাবে তুলে ধরছেন। বস্তুত, শুভেন্দু প্রায় প্রতিটি সভাতেই তাঁর বক্তৃতায় নিয়ম করে বলেছেন, তিনি এবং দিলীপ মিলে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ৩৫টি আসনে বিজেপি-কে জেতাবেন। এমনকি, ঘনিষ্ঠমহলেও একই বার্তা দিচ্ছেন শুভেন্দু। পক্ষান্তরে, দিলীপও বলছেন, শুভেন্দু ‘জননেতা’।
১৯ ডিসেম্বর বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন শুভেন্দু। তার পর গত প্রায় এক মাসে এমন আরও ঘটনা দেখা গিয়েছে। দিলীপের সঙ্গে শুভেন্দুর প্রথম সভা ছিল ২২ ডিসেম্বর পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে। সেখানে মঞ্চে সিংহাসনে বসেছিলেন দিলীপ। পাশে চেয়ারে শুভেন্দু। তা নিয়ে রাজ্য বিজেপি-তে আলোচনাও হয়েছিল। সেই আলোচনা ঘিরে কোনও বিতর্ক প্রকাশ্যে না এলেও চাপা ক্ষোভ ছিল শুভেন্দু-অনুগামীদের মধ্যে। এর পরে ৩ জানুয়ারি ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরে দিলীপের ডাকে শুভেন্দু সমাবেশে গেলেও পুরো সময় থাকেননি। নিজের বক্তব্য শেষ করেই ‘অন্য কর্মসূচি আছে’ বলে চলে যান। সেদিন অবশ্য মঞ্চে পাশাপাশি রাখা চেয়ারেই বসেছিলেন দিলীপ-শুভেন্দু।
৮ জানুয়ারি নন্দীগ্রামের মঞ্চে দিলীপকে আলিঙ্গনও করেন শুভেন্দু। কিন্তু সমাবেশে গোলমাল-হওয়া নিয়ে মঞ্চের পিছনে দু’পক্ষের অনুগামীদের মধ্যে বাদানুবাদ হয় বলেও বিজেপি-র একাংশের দাবি। যদিও দুই নেতাই ওই খবর উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ওই ঘটনায় ‘দাদা আঘাত পেয়েছেন’ বলে দাবি করেন শুভেন্দু-অনুগামীরা। অতঃপর ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে দিলীপ চেয়েছিলেন শ্যামবাজার থেকে সিমলা স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিলে তাঁর সঙ্গে হাঁটুন শুভেন্দুও। কিন্তু কলকাতায় থাকলেও সেই কর্মসূচি এড়িয়ে একাই সকালে বিবেকানন্দের বাড়িতে স্বামীজির মূর্তিতে মালা দিতে চলে যান শুভেন্দু। ৯ জানুয়ারি পূর্ব বর্ধমানে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার বিভিন্ন কর্মসূচিতে রাজ্যের বাকি সব নেতা থাকলেও দেখা যায়নি শুভেন্দুকে। তাঁর ঘনিষ্ঠারা জানান, সে দিনের কর্মসূচিতে শুভেন্দুকে নাকি ডাকাই হয়নি! যদিও শুভেন্দু ওই বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।
নন্দীগ্রামের মঞ্চে দিলীপকে আলিঙ্গন শুভেন্দুর।
একের পর এক এই ধরনের ঘটনায় সংবাদমাধ্যম থেকে সাধারণ মানুষের সামনে বঙ্গ বিজেপি-র ‘আদি-নব্য বিবাদ’ প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে বলে সরব দলের রাজ্য নেতাদের একাংশ। ৪ জানুয়ারি শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কৈলাসের মিছিলে না আসায় মুখ পোড়ে বিজেপি-র। হাসির খোরাক হতে হয় গেরুয়া শিবিরকে। এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় যে, কলকাতা জোনের পর্যবেক্ষক শোভন এবং সহ-আহ্বায়ক বৈশাখীর থেকে ‘দূরত্ব’ রক্ষা করে চলছেন রাজ্য নেতাদের বড় অংশই। কলকাতা জোন নিয়ে কেউ সে ভাবে মাথা ঘামাতে চাইছেন না।
এই পটভূমিকাতেই সোমবার কলকাতায় ‘ঐক্য প্রদর্শন’-এর মিছিল বিজেপি-র। দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে বিকেল ৩টের সময় মিছিল শুরু হওয়ার কথা। যাবে রাসবিহারী মোড় পর্যন্ত। সেখানে সন্ধ্যায় সমাবেশ। এখনও পর্যন্ত যা ঠিক হয়েছে, তাতে সেই মিছিলে কোনও কেন্দ্রীয় নেতা থাকবেন না। এমনকি, মুকুলও নন। থাকবেন দিলীপ, শুভেন্দু ছাড়া রায়গঞ্জের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী।
আরও পড়ুন: মমতা-অভিষেকে আস্থা জানিয়ে সপরিবার গোয়া চললেন শতাব্দী
নিজের লোকসভা কেন্দ্রের বাইরে তাঁকেও এখনও পর্যন্ত সে ভাবে দলীয় কর্মসূচিতে রাজ্য নেতৃত্ব ব্যবহার করেননি বলে ঘনিষ্ঠদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেবশ্রী। এ বার সোমবারের তাঁকে ডাকা হয়েছে। সোমবারের মিছিলে থাকতে বলা হয়েছে শোভন-বৈশাখীকেও। তবে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ওই দিনই ডায়মন্ড হারবারের বিষ্ণুপুরে র্যালি ও সমাবেশ করার কথা শোভন-বৈশাখীর।
সোমবারের মিছিল আয়োজনের দায়িত্বে থাকা বিজেপি-র সাংগঠনিক দক্ষিণ কলকাতা জেলার সভাপতি শঙ্কর শিকদার শনিবার বলেছেন, ‘‘বিষ্ণুপুর ও কলকাতা দুই কর্মসূচিতেই অংশ নেবেন ওঁরা।’’ সোমবারের মিছিলের কর্মসূচি কয়েকদিন আগেই ঠিক হয়েছে। এখন অমিতের কড়া নির্দেশের পরে মিছিলে সবাইকে একজোট করাটা বড় চ্যালেঞ্জ রাজ্য বিজেপি-র কাছে।
আরও পড়ুন: ২৩শে কি রাজ্যে মোদী, বঙ্গে বদলাচ্ছে কি হাল, জানতে চাইলেন শাহ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy