Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bhaifota

ফোঁটায় ফোঁটায় রাজনীতি, প্রতিপক্ষের ‘দুয়ারে কাঁটা’ বিছোতে তৎপর বিভিন্ন দলের দিদি এবং দাদারা

বাংলায় ভাইফোঁটা ঘিরেই রাজনৈতিক উত্তাপ। প্রতিপদে সেলিম গিয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীদের ধর্নামঞ্চে। দ্বিতীয়ায় গেলেন বিজেপির তনুজা। আর কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ফোঁটা মানে তো রাজনৈতিক উৎসব।

ভাইফোঁটার দুয়ারে কি রাজনীতির কাঁটা?

ভাইফোঁটার দুয়ারে কি রাজনীতির কাঁটা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ ২০:৪১
Share: Save:

অনেক বাঙালি পরিবারেই বাঁ-হাতের দিদি বা বোনের কড়ে আঙুলে দাদা বা ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার রীতি। ছোটেদের অভিধানে যে আঙুল আবার ‘আড়ি’ করারও। তাই অনেকে রসিকতা করে বলেন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হল ‘আড়ির আঙুলে ভাব’ করার দিন।

কিন্তু এখন সেটা রাজনীতি করার দিনও বটে। ফোঁটা-রাজনীতির ইতিহাস অবশ্য খুব পুরনো নয়। একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিলে অন্য নেতা-নেত্রীদের কাছে গোটাটাই হালফিলের। বাংলার রাজনীতি বরাবরই মূলত পুরুষতান্ত্রিক। ব্যতিক্রম তৃণমূল। এই দলের প্রতিষ্ঠা থেকে সর্বময় কর্তৃত্ব এক নারীর হাতে। তাই বাংলায় আর কোনও রাজনৈতিক দলেরই কোনও নির্দিষ্ট ‘দিদি’ নেই।মমতা অবশ্য কোনও দিনই ভাইফোঁটাকে ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ বানিয়ে দেননি। পরিবারে নিজের দাদাদের যে ভাবে ফোঁটা দেন, তেমনই রাজনীতিতে দলীয় সতীর্থ দাদা এবং ভাইদের ফোঁটা দিয়ে থাকেন ফি বছর। সেটা তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার প্রথম থেকেই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ভাইফোঁটা পালনে তেমন কিছু ফারাক দেখা যায়নি। বরাবরের মতো কালীঘাটের বাড়ির মধ্যেই ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রেখেছেন এই পার্বণকে।

বে রাজনীতি এমন একটি বিষয়, যা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে চায়। কাল অনুযায়ী বদলায় তার ক্ষেত্র। এখন তো রাজনীতি পালা-পার্বণেও আছে। সেটাই নতুন করে দেখিয়ে দিল বাংলার রাজনৈতিক দলগুলির ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন। সেই রাজনৈতিক পার্বণে পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির বার্তা নেই। বরং প্রতিপক্ষের দুয়ারে ‘রাজনৈতিক কাঁটা’ বিছানোর প্রাণপণ চেষ্টা রয়েছে।

শুরু হয়েছিল বুধবার প্রতিপদেই। এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচ্য শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ওঠা নানা দুর্নীতির অভিযোগে এবং নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কলকাতার রাস্তায় চলছে চাকরিপ্রার্থীদের টানা অবস্থান-বিক্ষোভ। বুধবার সেই মঞ্চে ফোঁটা নিতে গিয়েছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। রাজনীতিতে ধর্মীয় পরবের নজির এই অবস্থান মঞ্চই দেখিয়েছে।

লক্ষ্মীপুজোর দিন ‘প্রতীকী লক্ষ্মী’ সেজে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কালীপুজো এবং দীপাবলিও পালিত হয়েছে। বাদ পড়েনি ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানও। বুধবার গান্ধীমূর্তির পাদদেশে নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠানটি পালন করেছেন তাঁরা। বিকেলে সেখানে যান সেলিম। তাঁকে ফোঁটা দেন কয়েক জন চাকরিপ্রার্থী।

সেলিম অবশ্য এর মধ্যে রাজনীতি দেখছেন না। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘‘এটা সামাজিক বার্তা। আমরা চিরকালই ভাইফোঁটার দিন সামাজিক বার্তা দিয়ে থাকি। অনেক দিন ধরেই এই দিনে বামপন্থী কর্মীরা প্রান্তিক মানুষের কাছে ফোঁটা নিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তৃণমূল, বিজেপি। তবে ভাইফোঁটা ধর্মীয় ততটা নয়, যতটা পারিবারিক।’’ ধর্নামঞ্চে ফোঁটা নেওয়া প্রসঙ্গে সেলিমের বক্তব্য, ‘‘যে ছেলেমেয়েগুলো দিনের পর দিন গাছের তলায় বসে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। বামপন্থী রাজনীতিতেও এই কথা বলা হয়। সেই সম্পর্কের থেকেই ওঁরা ভাইফোঁটার আয়োজন করেছিলেন। আমি সেখানে গিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছি।’’

একই দাবি করছে গেরুয়া শিবিরও। বুধবারই বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ গিয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীদের অন্য একটি মঞ্চে। মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাদদেশের ধর্নাস্থলে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে মিষ্টি এবং বস্ত্র বিতরণ করেন। পরে দলীয় দফতরেও বিজেপির মহিলা মোর্চার নেতৃত্বের থেকে ফোঁটা নেন তিনি। বৃহস্পতিবার ভাইফোঁটার সকালে ফের ধর্নামঞ্চে যায় বিজেপি। দলের মহিলা মোর্চার সভানেত্রী তনুজা চক্রবর্তী গিয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীদের ফোঁটা দিতে। তার আগে তনুজা এবং দলের সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় রাজ্য দফতরে ফোঁটা দেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহকে। দিল্লিতে থাকায় ভাইফোঁটার উৎসব থেকে দূরেই থাকতে হয়েছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে। তবে দিলীপ শুধু রাজনৈতিক নয়, পারিবারিক ফোঁটাতেও ছিলেন। ঝাড়গ্রামে এক দিদির কাছে ফোঁটা নেন। ঠিক যেমন লকেট দক্ষিণেশ্বরে পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজের দাদাদের ফোঁটা দিয়েছেন।

ধর্নামঞ্চে ফোঁটা দিতে যাওয়া তনুজার গলাতেও ঘটনাচক্রে, সেলিমেরই সুর। তিনি বলেন, ‘‘এই দিনটা গোটা দেশেই পালিত হলেও বাঙালির কাছে অন্য অর্থ নিয়ে আসে। ৫৯২ দিন রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখানো ছেলেমেয়েগুলো তো পারিবারিক উৎসবে অংশ নিতে পারছেন না। তাই সেখানে গিয়েছি। বুঝিয়েছি, ওঁদের নায্য দাবির পাশে আমরা মহিলা মোর্চা রয়েছি। বিজেপি পরিবার রয়েছে।’’ প্রসঙ্গত, ভাইফোঁটাকে দলীয় কর্মসূচি না বানালেও রাখি এখন মূলত তৃণমূলেরই ‘উৎসব’। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বার্ষিক উৎসব ‘রক্ষাবন্ধন’-কে বিজেপি ততটা সামাজিক করতে পারেনি, যতটা তৃণমূল করেছে। ফলে গেরুয়া শিবিরের ‘রক্ষাবন্ধন’ এখন ‘রাখিপূর্ণিমা’ হয়েই বাংলার রাজনীতিতে বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবু সবচেয়ে আলোচিত কালীঘাটে মমতার বাড়ির ভাইফোঁটাই। এতটাই যে, ২০১৯ সালে তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ভাইফোঁটার দিন সস্ত্রীক মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। মমতার সময়ের অভাবে সেটা হয়নি। তবে মমতার বাড়ির কালীপুজোয় দেখা গিয়েছিল ধনখড় দম্পতিকে।

মমতা অবশ্য বরাবরই ভাইফোঁটাকে ‘ব্যক্তি পরিসরে’ রেখেছেন। তিনি শাসকই থাকুন বা বিরোধী— তাঁর বাড়ির ভাইফোঁটা রাজনীতির চেয়ে বেশি হয়ে থেকেছে পারিবারিক উৎসব। কিন্তু তাঁর মতো রাজনীতিকের বাড়ির ফোঁটায় রাজনীতির রং লাগবে না, তা-ও তো হয় না! ফলে তৃণমূলের মধ্যেই ফি বছর আলোচ্য হয়ে ওঠে, কারা কার্তিকের শুক্লা দ্বিতীয়ায় দিদির ডাক পেলেন আর কারা পেলেন না। তালিকায় অবশ্য খুব বেশি বদল হয় না। ধারাবাহিকতা রেখেই ফি বছর ফোঁটা পান শীর্ষ নেতারা। কিন্তু কিছু রদবদল প্রতিবারেই হয়। এ বারেও যেমন হয়েছে। ফোঁটা নিতে এসেছিলেন মুকুল রায়। এসেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। মমতা অন্যদের সঙ্গে তাঁদের ফোঁটা দিয়েছেন। দিদির মতো সামনে বসিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। তার পর প্রীতি উপহার দিয়েছেন।

আর দিন ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে— এ বারের তালিকায় কারা এলেন। কারা গেলেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Bhaifota Political parties Politics Bhaidooj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy