কমিশনের দফতরে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
গোড়ায় শাসক দলের চার নেতা-মন্ত্রীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাঝে ইস্তফা দিয়ে রাজ্য সরকারকে কার্যত পথে বসিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। সেই সঙ্কটকালে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ত্রাতা’ হয়ে আবির্ভূত হন পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে তড়িঘড়ি থিম্পু থেকে পাড়ি দেন কলকাতায়। তার পর কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিধাননগরের ৯টি এবং আসানসোলের ২টি বুথে পুর্ননির্বাচনের নির্দেশ দিয়ে তৃণমূল শিবিরে স্বস্তির বাতাস এনে দিয়েছেন তিনি।
বিরোধী শিবিরের ভোট বাতিলের দাবি উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘আজ্ঞাপালনের পুরস্কার’ কী হতে পারে, তা নিয়েই এখন জল্পনা শুরু হয়েছে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে। অনেকেরই মতে, পরবর্তী স্বরাষ্ট্রসচিব হওয়ার পথটা অনেকটাই নিষ্কণ্টক হয়ে গেল আলাপনবাবুর সামনে। আলাপনবাবু নিজে অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, রাজ্য সরকার যে দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছে, পেশাদার আমলা হিসেবে তা পালন করতে তিনি বাধ্য। তাঁর নিয়োগের নৈতিকতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যেও জড়াতে চান না তিনি। চান না স্বরাষ্ট্রসচিব পদের কাঁটার মুকুট পরতেও। এমনকী, এ নিয়ে কোনও আলোচনাও চান না। পুরভোট পর্ব মিটে গেলে ফিরে যেতে চান পরিবহণসচিবের পুরনো পদেই।
যা শুনে প্রশাসনের একাংশ কটাক্ষ করে বলছে, মমতার আমলে না-আঁচালে বিশ্বাস নেই। নেত্রীর মতিগতি কখন কোন দিকে ঘুরে যায়, তা তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠদেরও অজানা। ফলে স্বরাষ্ট্রসচিব পদ নিয়ে জল্পনা চলে তাঁর সম্ভাবনা বানচাল হোক, এটা আলাপনবাবু চান না। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কোপে পড়ে গত চার বছরে অনেকেই হিরো থেকে জিরো হয়েছেন। আবার মুখ্যমন্ত্রীকে ‘খুশি’ করতে পেরে অনেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। আলাপনবাবু এ বার যে ভাবে সরকারের গোললাইন সেভ করেছেন, তাতে পুরস্কার অনিবার্য।’’
পরবর্তী মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের পদে কারা বসবেন, তা নিয়ে প্রশাসনিক মহলে আলোচনা চলছে গত কয়েক মাস ধরেই। ১৯৮২ ব্যাচের আইএএস অফিসার তথা মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের দিল্লি চলে যাওয়ার খবরই এই আলোচনা উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সচিব হিসাবে এ রাজ্যের ১৯৮২ ব্যাচের আইএএসদের তালিকা থেকে শুধু হেম পাণ্ডের নাম বিবেচিত হয়।
তখন অনেকে ভেবেছিলেন, ২০১৯ পর্যন্ত সঞ্জয়বাবুই মুখ্যসচিব থেকে যাবেন। কিন্তু মুখ্যসচিবের নাম কেন্দ্রীয় সচিবের তালিকায় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে দরবার করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের অফিসাররা যাতে দিল্লিতে আরও সুযোগ পান, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন তিনি। তার পর কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ মন্ত্রক ফের ‘ক্যাডার রিভিউ’-এর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে ফের সবটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেই কাজও শেষের পর্যায়ে। এখন প্রধানমন্ত্রীর দফতর ১৯৮২ ব্যাচের আইএএস অফিসারদের মধ্যে চার না সাত— কত জনকে কেন্দ্রীয় সচিবের যোগ্য বলে বিবেচিত করবে, সেই সিদ্ধান্তটুকুই নেওয়ায় বাকি। নবান্নের খবর, এ বারের তালিকায় সঞ্জয়বাবুর নাম থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এবং সে ক্ষেত্রে কালীপুজোর পরেই হয়তো তাঁকে দিল্লি পাড়ি দিতে হবে।
যদি সেটা হয়, তা হলে রদবদল ঘটাতে হবে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তরেও। নবান্নের খবর, সঞ্জয়বাবু দিল্লি চলে গেলে ১৯৮৩ ব্যাচের আইএএস অফিসার তথা স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ই পরবর্তী মুখ্যসচিব হবেন বলে আপাতত ঠিক হয়ে রয়েছে। বাসুদেববাবুর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক বেশ ভাল। আর এই সরকারের আমলে শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি এবং তার পর স্বরাষ্ট্রসচিব পদে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন বলেই মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক মহলের খবর, পরবর্তী মুখ্যসচিব হিসাবে যে তাঁর কথাই ভেবে রেখেছেন, তা বাসুদেববাবুকে ইঙ্গিতে জানিয়েও দিয়েছেন মমতা।
বাসুদেববাবু মুখ্যসচিব হলে স্বরাষ্ট্রসচিব কে হবেন, সেই আলোচনায় এত দিন স্বাস্থ্যসচিব মলয়কুমার দে, ক্ষুদ্রশিল্প সচিব রাজীব সিংহ, পঞ্চায়েতসচিব সৌরভ দাস এবং পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উঠে আসত। সিনিয়র আমলাদের অনেকেই মনে করেন, এই চার জনের মধ্যে ১৯৮৫ ব্যাচের মলয়বাবু যোগ্যতর। স্বাস্থ্য দফতর ভাল সামলানোর পুরস্কার হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে পরবর্তী স্বরাষ্ট্রসচিব করতে পারেন, এমন একটা ইঙ্গিত মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রেও মিলেছিল।
কিন্তু আড়াইখানা পুরসভার ভোট সব হিসেব ওলটপালট করে দিয়েছে। নবান্নের এক শীর্ষকর্তার মতে, ‘‘আলাপন অস্থায়ী কমিশনারের পদগ্রহণ করে এবং শাসক দলকে সঙ্কট থেকে উতরে দিয়ে নিজের অবস্থান যথেষ্ট পোক্ত করে নিয়েছেন।’’ আর প্রাক্তন এক মুখ্যসচিবের কথায়, ‘‘আমি তো তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দেখতে পাচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
তবে আলাপনবাবুর স্বরাষ্ট্রসচিব হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আইনি প্রশ্ন তুলেছেন কর্মিবর্গ প্রশাসনিক দফতরের একাংশ। তাঁদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে স্বরাষ্ট্রসচিবের পদ অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (এসিএস) পর্যায়ের অফিসাররাই পেয়ে থাকেন। ১৯৮৫ ব্যাচের মলয়বাবু এসিএস হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ১৯৮৭ ব্যাচের আলাপনবাবু এখনও প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি। এখনই তিনি এসিএস হচ্ছেন না। ফলে ডিসেম্বর নাগাদ রদবদল হলে তাঁর ওই পদে বসা কঠিন।
যদিও নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চাইলে ওটা কোনও বাধা হতেই পারে না। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন বলেই অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পর্যায়ের আমলার জন্য বরাদ্দ ভূমিসচিব পদে দেড় বছর বসে ছিলেন এক জন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। এক জন যুগ্মসচিবকে সংখ্যালঘু দফতরের সচিবের কাজ করিয়েছিলেন তিনি। ফলে এক জন প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারিরও তাঁর আমলে স্বরাষ্ট্রসচিব হতে বাধা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy