ছত্রধরের সঙ্গে ফোনে কথাই সম্বল স্ত্রী নিয়তি মাহাতোর। — নিজস্ব চিত্র
ভরা চৈত্রের গুমোট দুপুর। লালগড়ের আমলিয়া গ্রামের মাটির বাড়ির উঠোনে পাতা খাটিয়ায় বসেছিলেন নিয়তি মাহাতো, জেলবন্দি ছত্রধর মাহাতোর স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই খেত থেকে এক ঝুড়ি শুকনো সূর্যমূখী ফুল এনে উঠোনে ফেলেছেন। খাটিয়া থেকে উঠে ফের ফুলগুলো শুকোতে দিলেন। তারই ফাঁকে নিতান্ত বিরক্তিতে বলে উঠলেন, ‘‘কী হবে কথা বলে? কত জনের কাছে আমাদের দুরবস্থার কথা বললাম, কিছুই তো হল না। মানুষটা সাত বচ্ছর ধরে জেলে পচছে।’’
সাত বছর আগেই এক অন্য ছবি দেখেছিল এই লালগড়। মাওবাদী নাশকতা আর জনগণের কমিটির আন্দোলনে জঙ্গলমহল তখন জ্বলছে। তিন জন আদিবাসীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর পেয়ে নিরাপত্তা ছাড়াই ছুটে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি বিরোধী নেত্রী। ৪ ফেব্রুয়ারি লালগড়ের খাসজঙ্গলে দাঁড় করানো ট্রাক্টরের খোলা ডালায় এক সঙ্গে সভা করেছিলেন মমতা আর জনগণের কমিটির মুখপাত্র ছত্রধর। সে দিন দু’জনের গলায় ছিল পরিবর্তনের দাবি।
সেই দিনটার কথা ভোলেননি ছত্রধরের তেইশ বছরের ঘরণী। বললেন, ‘‘দাদা আর বোনের সম্পর্ক ছিল ওঁদের দু’জনের। কত কথা, আসা-যাওয়া। ২০১১-তে তো আমার স্বামীকে তৃণমূলের হয়ে ভোটেও লড়তে বলেছিল। তার পর যেই গদিতে বসল সব বদলে গেল। সিপিএম ওকে জেলে ভরেছিল আর স্বার্থ ফুরনোয় তৃণমূল জেলে পচাচ্ছে।’’ ক্রমে সুর চড়তে শুরু করল নিয়তির, কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। যোগ করলেন, ‘‘আমাদের সংসার কী করে চলছে, কী খাচ্ছি, ছেলেদের ভবিষ্যৎ কী হবে কেউ খোঁজ নেয় না।’’
সাল ২০০৯। লালগড়ের সভায় মমতার পাশে ছত্রধর।
তবে যে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলছেন, জঙ্গলমহল হাসছে? ভোটের প্রচারেও তো সেই উন্নয়নের কথা?
নিয়তির গলায় বিদ্রূপ খেলে গেল। বললেন, ‘‘কীসের হাসি? লালগড়ের এই এলাকায় এখনও বহু বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। যা যা প্রতিশ্রুতি উনি দিয়েছিলেন তার কিছুই পূরণ করেননি। যৌথ বাহিনী সরেনি, মিথ্যে মামলা থেকে লোকজন রেহাই পায়নি।’’ তাঁদের তল্লাটে তৃণমূলের কোনও নেতা প্রচারে আসেননি বলেও জানালেন ছত্র-ঘরনি। কেন? নিয়তির গলায় ঝাঁঝ, ‘‘আসবে কোত্থেকে? এলাকার মানুষের সঙ্গে চোখ মেলাতে পারবে নাকি!’’
লালগড়ের তৃণমূল ব্লক সভাপতি বনবিহারী রায় অবশ্য অনুন্নয়নের কথা মানছেন না। বরং তাঁর দাবি, ‘‘লালগড় এতটাই পাল্টেছে যে অনেক দিন পরে যারা এলাকায় আসছে তারা চিনতেও পারে না।’’ তা হলে ছত্রধরের গ্রামে তৃণমূলের কেউ প্রচারে যায়নি কেন? এ বার আমতা আমতা করলেন শাসক দলের নেতা। তাঁর জবাব, ‘‘এত কাজ করেছি, তাতেই মানুষ ভোট দেবে। সব জায়গায় প্রচারের প্রয়োজন পড়ছে না।’’
২০১১-র ভোটে ছত্রধর জেলে থেকেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। তাঁর হয়ে প্রচারে বেরিয়ে এলাকা চষে ফেলেছিলেন নিয়তি। এ বার সেই নিয়তিরই ভোট নিয়ে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। তাঁর কথায়, ‘‘ভোট দিয়ে কোনও লাভ নেই তো। আমার ইচ্ছাও নেই। অনেকে মুখে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু আমি বলব। কী করবে? জেলে পুরবে?’’ ‘শান্তি’র জঙ্গলমহলে এ বার আর মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাক নেই। তবু নিয়তির কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল আমলিয়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বাঁশবেড় গ্রামেও। এখানকার বাসিন্দা সুখশান্তি বাস্কে ছিলেন জনসাধারণের কমিটির কোষাধ্যক্ষ। সাত বছর ধরে তিনিও জেলে। শুনশান, মলিন ঘরদোর আগলে রয়েছেন সুখশান্তির স্ত্রী দীপালি আর মা সুধারানি। প্রতিদিন খাবার জোটানো দায়। জমি আছে। কিন্তু চাষ করবে কে?
দীপালি ধুঁকছেন রক্তাল্পতায়। বছর তেত্রিশের দীপালি হলুদ রঙের জ্যালজ্যালে যে কাপড়টি পরে ছিলেন সেটি কিছুদিন আগে একটা বিয়েবাড়ি থেকে দিয়েছে। এর বাইরে আর মাত্র একটা কাপড় রয়েছে তাঁর। উঠোনের খুঁটিটা জড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তিনিও বললেন, ‘‘আমাদের কোনও সরকার নেই, কোনও নেতা নেই। কেন ভোট দেব? সিপিএমকে দেখলাম, মমতাকেও তো দেখলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy