এজেন্টরা কী ভাবে শিক্ষকতার চাকরির ‘টোপ’ ফেলতেন, কী ভাবেই বা খুঁজে পেতেন চাকরিপ্রার্থীদের, টাকা কোথা থেকে কোথায় যেত— এই সব বিষয়েই প্রাথমিক ভাবে ছবি কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। ফাইল চিত্র।
কী ভাবে চলত এই দুর্নীতির চাকা? আড়ালেই বা থেকে গিয়েছেন কোন কোন প্রভাবশালী?
সবই এখন সিবিআই এবং ইডি-র তদন্ত সাপেক্ষ এবং তার পরে আদালতে তা বিচার্যও বটে। তবে এই দালাল বা এজেন্টরা কী ভাবে শিক্ষকতার চাকরির ‘টোপ’ ফেলতেন, কী ভাবেই বা খুঁজে পেতেন চাকরিপ্রার্থীদের, টাকা কোথা থেকে কোথায় যেত— এই সব বিষয়েই প্রাথমিক ভাবে ছবি কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের দাবি, দুর্নীতির গোড়ায় রয়েছে বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলির একাংশ। সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের খোঁজ সহজেই পেতেন দালালেরা। পাশাপাশি, বিরোধীদের অভিযোগ, নেতা বা নেতার কাছের লোক, এই পরিচয়কেও কাজে লাগাতেন দালালেরা।
নিয়োগ-দুর্নীতির অন্যতম এজেন্ট হিসেবে উঠে এসেছে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাসিন্দা তাপস মণ্ডলের নাম। একদা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাপস রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূলের সঙ্গে সখ্য বাড়ান। বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ সংগঠন, ‘অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতিও হন। তাপসের নিজেরও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ আছে। তদন্তকারীদের ধারণা, এই কলেজগুলিতে সহজেই চাকরিপ্রার্থীদের খুঁজে টোপ ফেলতেন দালালেরা। ইডি-র একটি সূত্রের দাবি, ২০১২ থেকে ২০১৭-র মধ্যে ছয় থেকে দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বেআইনি নিয়োগ হয়েছে। ঘটনাচক্রে ২০১২-তেই ওই সংগঠনটিও ভূমিষ্ঠ হয়। চাকরিপ্রার্থীদের একাংশের অভিযোগ, এলাকার দালালদের নিশানায় ছিলেন প্রাথমিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরাও। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার জন্য আবেদনের পরেই চাকরির টোপ দেওয়া হত বলে অভিযোগ।
শাসকের সঙ্গে দহরম মহরম— এই পরিচয়ও এজেন্টরা কাজে লাগিয়েছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তাঁরা তিনটি উদাহরণ দিচ্ছেন— প্রথমত, নদিয়া জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য টিনা ভৌমিক সাহা। টিনার বিরুদ্ধে অস্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রে দাবি, রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি নিয়োগ-দুর্নীতিতে যুক্ত। টিনা আবার তেহট্টের দলীয় বিধায়ক তাপস সাহার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ করেন। অভিযোগ অস্বীকার করে তাপস আবার পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, টেট পাশ না করেও টিনা কী করে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেলেন? টিনা কোনও অভিযোগেই আমল দেননি।
এর বাইরেও নদিয়ায় রয়েছে আরও একটি নাম। তিনি তাপস সাহা ‘ঘনিষ্ঠ’ প্রবীর কয়াল। বিরোধীদের অভিযোগ, সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়েই নিয়োগ-দুর্নীতিতে যুক্ত প্রবীর। যদিও, বর্তমানে জামিনে মুক্ত প্রবীর তোপ দেগেছেন তাপসের বিরুদ্ধেই। তাপসের অবশ্য দাবি, প্রবীর তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন না।
দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, গ্রেফতার হওয়া কাঁথির স্কুল শিক্ষক দীপক জানা এলাকায় নিজেকে ‘পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির’ নেতা হিসাবে পরিচয় দিতেন বলে স্থানীয়দের একাংশের দাবি। যদিও, শিক্ষক সংগঠনটি জানিয়েছে, দীপক সংগঠনের সদস্য হতে পারেন। কিন্তু পদাধিকারী নন।
তৃতীয়ত, কোলাঘাটে স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, হিডকোর কর্মী এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সুব্রত সামন্ত রায় টাকার বিনিময়ে নাকি অনেককেই স্কুলে চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন।
প্রাথমিকে চাকরি বিক্রির ‘লাভের গুড়ের’ হিসাব সম্প্রতি আলিপুরের নগর দায়রা আদালতে দিয়েছে সিবিআই। তাদের দাবি, কারও প্রাপ্ত নম্বর যদি ৭০ শতাংশ হয়, তবে তা ৭২ শতাংশ করতে আলাদা দর। আবার ৬৫ শতাংশকে ৭২ শতাংশ করতে বেশি দাম। এই অর্থ যেত দালালদের হাতে এবং সেখান থেকে অন্যত্র। ‘অন্যত্রটা’ কী ভাবে এবং কোথায়? বিশেষ সূত্রের দাবি, দালালেরা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকার খাম এবং যোগ্যতার নথি পৌঁছে দিতেন এলাকার ‘প্রভাবশালী নেতার’ কাছে। তার পরে জেলার কোনও ‘প্রভাবশালী’ হয়ে সে টাকা আরও উঁচু স্তরে পৌঁছত বলেই দাবি তদন্তকারীদের। সূত্রের দাবি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে চাকরিপ্রার্থীদের থেকে কমপক্ষে চার হাত বদলে টাকা পৌঁছত জেলার মাথাদের কাছে। সেখান থেকে কলকাতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy